অনলাইন ডেস্ক:
সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শুরুতেই সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমিয়ে দিয়েছে। ১ জুলাই থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। ফলে যারা সঞ্চয়পত্রকে একটি নিরাপদ বিনিয়োগ ও মাসিক আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন— বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ, গৃহবধূ, প্রবাসী পরিবারের সদস্য ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি— তারা অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়েছেন।
অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে বলেছেন, ‘সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার বেশি থাকলে মানুষ ব্যাংক ছেড়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে ঝুঁকে পড়বে। এতে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট তৈরি হবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের টেকসই পরিচালনার জন্য সেখানে পর্যাপ্ত আমানত থাকা প্রয়োজন। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়লে সরকারের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা কমে যেতে পারে। তাই এ বিষয়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।’
কেন কমানো হলো মুনাফার হার?
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, পাঁচ ও দুই বছর মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বন্ডের গড় সুদের হার বিবেচনায় নিয়েই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার নির্ধারণ করা হয়। প্রতি ছয় মাস পরপর এটি পর্যালোচনা করা হয়। সর্বশেষ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ট্রেজারি বন্ডের হার কিছুটা কমে গেছে। সেই অনুযায়ী জাতীয় সঞ্চয় স্কিমেও মুনাফার হার কমানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি বছরের ১ জুলাইয়ের আগে যেসব সঞ্চয়পত্র ইস্যু হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে আগের মুনাফার হার বহাল থাকবে। তবে মেয়াদ শেষে পুনঃবিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন মুনাফার হার প্রযোজ্য হবে।
কতটা কমলো মুনাফা?
সঞ্চয়পত্রের প্রায় প্রতিটি স্কিমেই এবার মুনাফার হার কমেছে। যেমন- পরিবার সঞ্চয়পত্রে যেখানে আগে সাড়ে সাত লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মুনাফা মিলত ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সাড়ে সাত লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে হার কমে হয়েছে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা আগে ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
একই ধরনের পরিবর্তন এসেছে পেনশনার সঞ্চয়পত্রেও। আগে যেখানে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যেত, এখন তা নেমে এসেছে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশে। বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র এবং তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রেও মুনাফার হার গড়ে ০.৫০ থেকে ০.৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের মেয়াদি হিসাবেও একই প্রবণতা দেখা গেছে।
কে কতটা চাপে পড়বে?
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের সুদ কমানোর সিদ্ধান্ত হয়তো আর্থিক দিক থেকে যৌক্তিক, কিন্তু এর সামাজিক প্রভাব গভীর। দেশে এমন একটি বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে— যাদের জন্য সঞ্চয়পত্র একমাত্র নির্ভরযোগ্য আয়ের সূত্র। তাদের মধ্যে আছেন অবসরপ্রাপ্ত পেনশনার, গৃহবধূ, প্রবাসী পরিবারের সদস্য, অসুস্থ কিংবা কর্মহীন ব্যক্তি এবং শহর ও মফস্বলের মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
বিশেষ করে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার হ্রাস প্রবীণ নাগরিকদের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। অনেকের মাসিক খরচ, চিকিৎসা ব্যয় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর নির্ভরশীল। এই হার হ্রাস মানে তাদের জন্য এক ধরনের ‘আর্থিক ধাক্কা’।
মধ্যবিত্তের জন্য ত্রিমুখী চাপ
সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা অপরিবর্তিত রেখেছে— ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর মানে, এর বেশি আয় হলে কর দিতে হবে। অথচ চলমান মূল্যস্ফীতিতে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন। এর সঙ্গে যোগ হলো সঞ্চয়পত্রের মুনাফা হ্রাস। ফলে মধ্যবিত্তের ওপর একসঙ্গে তিনটি চাপ তৈরি হয়েছে— মূল্যস্ফীতি, কর এবং সঞ্চয় আয়ে ধস।
সীমিত আয়ের মানুষ কি কিছুটা লাভবান?
সঞ্চয়পত্রের নতুন নিয়ম অনুযায়ী, সাড়ে সাত লাখ টাকার নিচে বিনিয়োগে কিছুটা বেশি মুনাফা রাখা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সীমিত আয়ের মানুষ যেন এই সংকটময় সময়ে কিছুটা স্বস্তি পান, সেজন্যই এই ব্যবস্থা। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, সীমা যদি ১০ লাখ পর্যন্ত বাড়ানো হতো, তাহলে আরও বৃহৎ জনগোষ্ঠী এই সুফল পেতে পারতো।
আইএমএফের শর্ত: মূল চালিকা শক্তি?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান অনুঘটক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণচুক্তির শর্ত। আইএমএফের অন্যতম শর্ত হলো— ঘাটতি বাজেট পূরণে অভ্যন্তরীণ ঋণের মাত্র এক-চতুর্থাংশ যেন সঞ্চয়পত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শও দিয়েছে সংস্থাটি। অর্থাৎ ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় হার যা হবে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সঞ্চয়পত্রে সুদহার নির্ধারিত হবে।
সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের চুক্তিতে সই করে। এরপর থেকে প্রতিটি বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে যেখানে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা, সেখানে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা কমিয়ে আনা হয়েছে মাত্র ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সঞ্চয়পত্র সামাজিক নিরাপত্তার অংশ হলেও আইএমএফের চোখে এটি সরকারের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি দায়। কারণ, প্রতি বছর এ বাবদ সরকারকে বিপুল অঙ্কের সুদ পরিশোধ করতে হয়।
বিকল্প ব্যবস্থা কী?
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমিয়ে দেওয়া হলে সামাজিক নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারের উচিত বয়স্ক নাগরিকদের জন্য পৃথক পেনশন স্কিম, সামাজিক ভাতা এবং অনুদানভিত্তিক সহায়তা জোরদার করা।
সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, ‘মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর নির্ভরশীল। ব্যাংক ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি পূরণের চেয়ে বরং সঞ্চয়পত্র থেকে অর্থ সংগ্রহ করা সুস্থ বিনিয়োগ ব্যবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে ভালো হতো।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির বাস্তবতায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। অথচ সঞ্চয়পত্রের আকর্ষণ হারালে এই শ্রেণিগুলো আরও ঝুঁকির মুখে পড়বে।’
ভবিষ্যতের ইঙ্গিত: ফের পর্যালোচনা হবে
অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ছয় মাস অন্তর সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার পুনরায় পর্যালোচনা করা হবে। আগামী জানুয়ারিতে আবারও ট্রেজারি বন্ডের হার পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হতে পারে। তবে এর মধ্যবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণির ওপর চাপ থেকে যাবে।
সংকোচনের নীতি বনাম সামাজিক নিরাপত্তা
সঞ্চয়পত্র কেবল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ নয়— এটি একটি সামাজিক নিরাপত্তার স্তম্ভ। এ খাতে সুদ কমানো মানে সরকারের সেই সুরক্ষা বলয় সংকুচিত হওয়া। সরকার সংকোচনমূলক বাজেট ও মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে, ঠিক তখনই সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর সিদ্ধান্ত এসেছে। এতে একদিকে সরকারি দায় কমলেও, অপেরদিকে জনগণের আস্থা ও সঞ্চয়ের প্রবণতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।