আমার কাছে মা- খালা, চাচীদের শিল্পী মনে হয়, তাদের একেকটা কাজে শৈল্পিকতা বিদ্যমান। মনে পড়ে যখন ছোট্ট আমি, মাঝে মাঝে নানি বাড়ি যেতাম, টিনের ঘর ছিল যেখানে শীতকালে ভোরবেলা টুপটাপ করে শিশির পড়তো। ভোরে উঠা নিষেধ ছিল, আমি লেপের ওমে শুয়ে শুয়ে শুনতে পেতাম নানি হাঁসের ঘরের দরজা খুলে দিয়ে একটি বিশেষ স্বরে-আয় চৈ চৈ বলে ডাক দিতেন আর হাঁসগুলো হৈ চৈ করে খাবারের ডিব্বায় মুখ নামায়ে চপ চপ করে খেত। নানির সেই সুর করে চৈ চৈ বলা আমার কাছে এখনো ভীষণ শৈল্পিক মনে হয়।
তখন গ্রামে বিদ্যুৎ যায়নি, ঘরের থামের সাথে হারিকেন ঝুলানো থাকতো। নানি সকাল বেলা সেই হারিকেন পেড়ে পুরনো নরম কাপড় দিয়ে মুছতেন, হারিকেনগুলো ঝকঝক করে উঠতো। তবে আমার বেশি ভালো লাগতো হারিকেনের কাঁচ মোছার দৃশ্য, হারিকেনের কাঁচের একপাশে মুখ দিয়ে ফুঁ দিয়ে ভাপ দিতেন আর আরেকপাশে অপর হাতটি রাখতেন, ফুঁ দেওয়াতে কাঁচটি ঘোলাটে হয়ে যেত আর নানি কাঁচ মোছা নরম কাপড় দিয়ে হাত ঘুরায়ে ঘুরায়ে কি যে নান্দনিকভাবে কাঁচ মুছতো, আমি খালি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম! এরপর আসতো বাড়ির কাজের লোক শিউলির মা, তার আসল নাম যে কি তা আজো জানি না! সবাই বলে শিউলির মা আমিও বলতাম শিউলির মা, সব সম্বোধনের উর্ধ্বে উঠতো সে একটি কন্যা সন্তানের মা এই পরিচয়! সে এসেই ডালা ভর্তি বাসি থালা-বাসন নিয়ে বসতো পুকুরের সিঁড়িতে আর আমি গাছের নিচে দাঁড়ায়ে দেখতাম, চুলা থেকে উঠানো সাদাটে মিহি ছাই দিয়ে আর খড়কে মাজুনি বানায়ে কাঁসা, এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন আর স্টিলের গ্লাস খুব চমৎকারভাবে মাজতো।
ছাই মেখে গ্লাসগুলো কেমন ভূত হয়ে থাকতো তারপর পুকুরের পানিতে ধুলেই ম্যাজিক! একদম নতুন চকচকে গ্লাস যেন, দেখলেই মনে হতো এক গ্লাস পানি খাই! গ্লাস যে মাজতো তার একটা ছন্দ ছিল সাথে ছিল খস খস শব্দ। স্টিলের প্লেট হলে তাকায়ে দেখতো নিজের চেহারা ভালো করে দেখা যায় কিনা! চেহারা ভালো করে দেখা গেলেই বাসন মাজার কাজটা ভালো হয়েছে বোঝা যাবে আর না হলে আমার খুঁতখুঁতে নানি বলবে, ‘ঘোলা গ্লাস প্লেটে খাওয়া যায় নাকি’! এরপর সে আবার মাজতে বসবে আবার সেই ছান্দসিক খস খস, খস খস শব্দ! চোখ বুজলেই এখনো সেটা শুনতে পাই যেন! ঈদের সময় দাদি বাড়ি ঢুকলেই দেখতে পেতাম ঈদ উপলক্ষ্যে আমার মেজ’মা (চাচী) ঝকঝকে করে উঠান লেপে রেখেছেন, বাড়ির উঠানে পা দিলেই মন ভালো হয়ে যেত! এই উঠান লেপার উপকরণের আবার ভারসাম্য না রাখলে ঠিকমতো লেপা হয় না এজন্য মেজ মা নিজেই এটা করতেন। আমার মেজ মা আর সেজ মা এর ঘরে ঢুকলেই আমার প্রধান কাজ ছিল দেওয়ালে ঝুলানো কাপড়ের উপরে সুঁই সুতার কাজের বাঁধানো লেখা আধুনিক কালে যাকে বলে ওয়াল ম্যাট সেগুলো পড়া। সাদা কাপড়ের উপরে রঙিন সুতার সূক্ষ্ম হাতের কাজে কত চমৎকার ছন্দ যে লেখা থাকতো, এই যেমন –
”রূপে ভোলে আঁখি
গুণে ভোলে মন
এ কথাটি সারা জীবন
রাখিও স্মরণ
রূপের প্রশংসা অতি অল্পক্ষণ
গুণের প্রশংসা মরিলেও থাকে স্মরণ’।
আরো লেখা ছিল –
“দুঃখে যাদের জীবন গড়া
দুঃখে তাদের কিসের ভয়?”
তবে আমার সবচেয়ে ভালো লাগার ছন্দটি ছিল –
“জীবনের প্রথম শাঁখে
যে কোকিল আগে ডাকে
হোক সে কুৎসিত কালো
তবু সে মোর জীবনের আলো।”
আর চাচী ফুফু সবার ঘরে আমার মৃতা দাদীর নাম, তার মৃত্যুর তারিখ সুঁই সুতার ভালোবাসায় বাঁধানো ছিল। আমার মায়ের রান্না তো আমার কাছে সবচেয়ে বড় শিল্প মনে হয়। আস্তে ধীরে রান্না করে মা, তাড়াহুড়ার রান্না তাঁর ভীষণ অপছন্দ, তাতে নাকি স্বাদ কমে যায়। সব সময় অল্প পদের রান্না করেন কিন্তু সেই রান্নাটুকুতে লেগে থাকে যত্ন আর ভালোবাসার ছোঁয়া।
চুলায় কড়াই দিয়ে এরপর তেল দিয়ে সবজী তরকারি ফেলে ভীষণ শৈল্পিকভাবে সেটা নাড়েন তারপর এই আনাজ পাতি, হলুদ লবণ দিয়ে যখন পুণরায় নাড়েন তখন সেটাকে আমার কোন শিল্পীর ক্যানভাস বলে মনে হয়ে, যেন ধীরে ধীরে রঙে রঙিন হয়ে উঠে। আমার মা যখন কড়াই চুলা থেকে নামায়ে রাখেন তার উপরে এক পুরু সরের মত আস্তরণ পড়ে তার সেই ঝোলটুকু দিয়েই মা এর রান্না করা নরম কিন্তু ঝরঝরে ধোঁয়া উঠা গরম ভাত দিয়ে কয়েক প্লেট খেয়ে উঠা যায়! আমি জানি শুধু আমার মা নয়, সব মা, সব খালা, সব চাচী বা নানিই এমন শিল্পী। আমরা হয়তো দেখি কিন্তু খেয়াল করি না কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবো কী ভীষণ যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে তাঁরা অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে প্রাত্যহিক কাজগুলো করে চলেছেন। সশ্রদ্ধ ভালোবাসা স্বীকৃতি না পাওয়া এইসব শিল্পীদের প্রতি…
লেখক-ইয়াসমিন নাহার:
জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সাতক্ষীরা।