হোম অর্থ ও বাণিজ্য লোহিত সাগর সংকটে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে

লোহিত সাগর সংকটে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 68 ভিউজ

বাণিজ্য ডেস্ক:

লোহিত সাগরে চলমান অস্থিরতা প্রভাব ফেলছে বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায়। কফি থেকে শুরু করে ফল পর্যন্ত সব পণ্যের চালানই ধারাবাহিকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে আবারও বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া নিয়ে। অর্থাৎ এরই মধ্যে দোদুল্যমান খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য নতুন হুমকি লোহিত সাগর সংঘাত।

ব্লুমবার্গের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লোহিত সাগরে চলমান অস্থিরতার মুখে কফি থেকে শুরু করে ফল পর্যন্ত প্রায় সব পণ্যের চালান ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে, যা নতুন করে অস্বস্তিতে ফেলবে ভোক্তাদের।

ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর লোহিত সাগর রুটে পণ্যবাহী জাহাজগুলো লক্ষ্য করে আক্রমণের জেরে অনেক জাহাজ ও সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনকারী কোম্পানি আফ্রিকার সুদূর দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত কেপ অব গুড হোপ রুট দিয়ে তাদের জাহাজ ঘুরিয়ে পরিবহন করছে। এর মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বোঝাই জাহাজের সংখ্যাই বেশি। এই রুট দিয়ে পণ্য পরিবহনে যেমন বেশি সময় ব্যয় হচ্ছে, তেমনি বাড়তি অর্থও গুনতে হচ্ছে। দীর্ঘ সময় পরিবহনের ফলে গ্যাস, তেল এবং ভোগ্যপণ্যের ওপর যতটা-না প্রভাব পড়ে, তার থেকে অনেক বেশি প্রভাব পড়ে পচনশীল খাবার পরিবহনে। এর জন্য অনেক সময়ই খাবার নষ্ট বা খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়। তা হয়ে ওঠে বিক্রি অযোগ্য।

ফলে এ খাত বড় ধাক্কা খেতে যাচ্ছে বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা। বিকল্প পথ দিয়ে কিউই ও সাইট্রাস ফল পরিবহনে সেগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ইতালীয় রফতানিকারকরা। এদিকে ক্রমাগত দাম বাড়ছে চীনা আদার আর কিছু আফ্রিকান কফির চালান হচ্ছে বিলম্বিত। অপরদিকে সুয়েজ খাল দিয়ে খাদ্যশস্য পরিবহন সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। আর মধ্যপ্রাচ্যগামী একটি গবাদি পশু বহনকারী জাহাজ রুট পরিবর্তন করে বিকল্প রুট দিয়ে এগোচ্ছে।

যদিও এখন পর্যন্ত সরবরাহ ব্যবস্থায় এর প্রভাব সীমিত, তবে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা যে কতটা হুমকির মধ্যে রয়েছে, চলমান পরিস্থিতি সেই দিকেই ইঙ্গিত দেয়। যদি পণ্য পরিবহন আরও বাধার মুখে পড়ে, তাহলে তা খাদ্যপণ্যের মূল্যের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে।

লোহিত সাগর রুট দিয়ে ইউরোপে পণ্য সরবরাহ করে থাকে ভারতীয় আঙ্গুর রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ইউরো ফ্রুটস। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এখন এ পথ এড়িয়ে দীর্ঘ রুট ব্যবহার করে ফল পরিবহন করায় অন্যতম প্রধান রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানটির চার গুণেরও বেশি জাহাজ ভাড়া বহন করতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে ট্রানজিট সময় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এ বিষয়ে ইউরো ফ্রুটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিতিন আগরওয়াল বলেন, এখানে খাদ্য ব্যবস্থার সবাই ভুক্তভোগী হচ্ছে। চলমান পরিস্থিতির কারণে আঙ্গুরের গুণগতমান নষ্ট হচ্ছে। বেশিরভাগ ইউরোপীয় আমদানিকারক চড়া মূল্যে আঙ্গুর কিনতে রাজি হয়েছেন। যা দিনশেষে বহন করতে হবে ভোক্তাকেই।

ইউরোপিয়ান ফ্রেশ প্রোডাক্ট অ্যাসোসিয়েশন ফ্রেশফেল তথ্যানুসারে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাধারণত তাদের চাহিদার প্রায় সপ্তমাংশ আঙ্গুর আমদানির জন্য ভারতের ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে মার্চ-এপ্রিলেই ৩৫ শতাংশেরও বেশি আমদানি করা হয়।

ফার্ম গ্রুপ কনফ্যাগ্রিকোল্টুরার প্রেসিডেন্ট ম্যাসিমিলিয়ানো জিয়ানসান্টি বলেছেন, এশিয়ার দেশগুলোয় প্রায় ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের কৃষিপণ্য বিক্রি করেন ইতালীয় রফতানিকারকরা। আফ্রিকা দিয়ে ঘুরে পণ্য পরিবহন করা হলে আপেল, কিউই এবং সাইট্রাসের মতো ফল সতেজতা হারাবে বলে উদ্বিগ্ন তারা। সেই সঙ্গে এসব ফলের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়েও তারা শঙ্কিত।

একই ধরনের উদ্বেগ বিরাজ করছে মাংসের বাজারে। এ বিষয়ে অল ইন্ডিয়া বাফেলো অ্যান্ড শিপ মিট এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র ফৌজান আলাভি বলেন, উত্তর আফ্রিকার মতো অঞ্চলগামী ভারতীয় মহিষ-মাংসের চালান বিলম্বিত হচ্ছে।

আমদানিকারক ও রফতানিকারকদের পাশাপাশি এই লোহিত সাগর সংঘাত মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে কৃষকদেরও। কারণ, চড়া পরিবহন ভাড়ার মেটাতে তাদের দাম কমাতে বাধ্য হতে হবে। ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের আঙ্গুর চাষি সন্দীপ দাগু সন্ধন বলেন, দাম পড়ে গেলেও বিক্রি করতে হবে। কারণ, আমরা ফসল কাটার সময়কাল বাড়াতে পারব না। রফতানিকারকরা সবসময়ই তাদের খরচ কোনো না কোনো জায়গা থেকে উঠিয়ে নিতে পারেন। বিপরীতে দাম কমে গেলে আমাদের ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।

এগ্রি-ফুড ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা সিইএলসিএএর তথ্যানুসারে, শিপিং সমস্যারগুলো কারণে ইউরোপে শূকরের মাংস, দুগ্ধ ও ওয়াইনের মতো পণ্যগুলোর রফতানির পাশাপাশি চা, মসলা এবং হাঁস-মুরগির আমদানি নিয়েও ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ বিরাজ করছে। যদিও এর কোনো প্রভাব এখনও তেমন একটা স্পষ্ট নয়।

এদিকে গোয়েন্দা সংস্থা কেপলার জানিয়েছে, বিগত কয়েক সপ্তাহে সুয়েজ খালের দিকে এগিয়ে যাওয়া প্রায় ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন শস্য বহনকারী বেশ কয়েকটি জাহাজ তাদের রুট পরিবর্তন করে অন্য রুট দিয়ে চলাচল শুরু করেছে। এসব পণ্যের অধিকাংশই সরবরাহ করা হবে চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।

এ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের মুদিপণ্যের জায়ান্ট টেসকো পিএলসি সতর্ক করেছে যে শিপিং ব্যাঘাত হলে কিছু কিছু পণ্যের দাম অনেক বেশি বেড়ে যেতে পারে। এদিকে ইস্ট লন্ডনের নিউ স্পিটালফিল্ডস মার্কেটে গত ডিসেম্বর থেকে তাজা আদার দাম এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি বেড়েছে। এ বিষয়ে পাইকারি বিক্রেতা আমের সুপারফ্রেশ লিমিটেডের মুহাম্মদ প্যাটেল বলেন, ‘লোহিত সাগর এড়িয়ে আফ্রিকা দিয়ে জাহাজ চলাচল করায় বাড়ছে পরিবহন ব্যয়। ফলে বাড়ছে পণ্যে দাম। প্রায় সময়ই আমরা দেরিতে পণ্যের চালান পেয়ে থাকি। এবারের মতো আগের কখনো হয়নি।’

ইউরোপের কপি আমদানির বড় উৎস হচ্ছে উগান্ডা ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো। ওই সব দেশে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের একটি রুট হচ্ছে লোহিত সাগর। কফি পরিবহন নিয়ে ভিয়েতনাম কফি কোকো অ্যাসোসিয়েশেন জানিয়েছে, যদিও পচনশীল খাবারগুলো সাধারণত কনটেইনারে পরিবহন করা হয়, তবে কিছু কফি কোম্পানির তাদের পণ্য বাল্ক ক্যারিয়ায়ে পাঠাচ্ছে। ফলে বন্দরের মতো জায়গায় এইসব চালান পরিচালনা করা কঠিন হয়ে উঠবে। এতে কফি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন