জাতীয় ডেস্ক:
একটি-দুটি নয়, একে একে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘৩০ খুনে’ জড়িত মিয়ানমারের সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার শীর্ষ নেতা মৌলভী আকিজ। প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করা রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা থেকে শুরু করে সেভেন মার্ডার, গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা হত্যা ও হেড মাঝি থেকে শুরু করে সাব মাঝি ক্যাম্পে এমন একাধিক রোহিঙ্গা হত্যায় জড়িত তিনি। যার বিরুদ্ধে রয়েছে ২১টিরও বেশি মামলা।
সোমবার (১০ জুন) দুপুরে কক্সবাজার কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন র্যাব ১৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচএম সাজ্জাদ হোসেন। রোববার (৯ জুন) মৌলভী আকিজসহ পাঁচজনকে গ্রেফতারের পর ব্রিফিং করছিলেন তিনি।
রোববার দিবাগত মধ্যরাতে উখিয়ার ৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি পরিত্যক্ত ঘরে অভিযান চালিয়ে আকিজসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় একটি বিদেশি পিস্তল, একটি দেশীয় তৈরি এলজি, একটি ওয়ান শুটারগান, ১০ রাউন্ড কার্তুজ, ২ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য, তিনটি মোবাইল ফোন এবং নগদ আড়াই হাজার টাকা উদ্ধারের তথ্য জানিয়েছে র্যাব।
গ্রেফতার ৫জন হলেন: উখিয়ার ৫ নম্বর ক্যাম্পের মৃত আবুল বাশারের ছেলে মো. শহিদুল ইসলাম ওরফে মৌলভী অলি আকিজ (৫০), ৬ নম্বর ক্যাম্পের মৌলভী আনোয়ারের ছেলে মো. ফয়সাল ওরফে মাস্টার ফয়সেল (২৮), ২০ নম্বর ক্যাম্পের মৃত মৌলভী রহমত উল্লাহর ছেলে হাফেজ ফয়জুর রহমান (২৪), ৮ নম্বর ক্যাম্পের মৃত করিম উল্লাহর ছেলে মো. সালাম ওরফে মাস্টার সালাম (২০) এবং ২২ নম্বর ক্যাম্পের আনু মিয়ার ছেলে মো. জুবায়ের (২৪)।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব ১৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচএম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করতেন রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহ; যাকে ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পে গুলি করে হত্যা করা হয়। যার মূল পরিকল্পনকারী ছিলেন এই আকিজ।
তিনি বলেন, শুধু মাস্টার মুহিবুল্লাহ নন; মিয়ানমারের সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার শীর্ষ নেতা মৌলভী আকিজের নেতৃত্বে ক্যাম্পে সংগঠিত হয় সেভেন মার্ডার। তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডে। এরপর ক্যাম্পের সাব মাঝি কিংবা হেড মাঝি যারাই আরসার বিরুদ্ধে গেছে; তাদেরই খুন করা হয়। এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন মিয়ানমারে।
সংবাদ সম্মেলনে এইচএম সাজ্জাদ হোসেন আরও জানান, গোয়েন্দা তথ্য ছিল- আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী দীর্ঘ সময় ধরে মিয়ানমারে পালিয়ে আত্মগোপনে থাকলেও, গত ১৯ মে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফিরেছেন। আরসার শীর্ষ কমান্ডার আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি এবং সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ওস্তাদ খালেদের নির্দেশে ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারের নতুন পরিকল্পনা নিয়ে অপতৎপরতা চালাচ্ছেন। এর প্রেক্ষিতে র্যাব-১৫ এর আভিযানিক দলের তৎপরতা বাড়ে।
রোববার (৯ জুন) রাতে মৌলভী আকিজসহ ৮/১০ জন আরসা সদস্য ৪ নম্বর ক্যাম্পের একটি পরিত্যক্ত ঘরে গোপন বৈঠক করছেন- এমন তথ্য নিশ্চিত হয়ে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছে ৫ জন।
র্যাবের ওই কর্মকর্তা আরও জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যমতে; মৌলভী অলি আকিজ ২০১৭ সালে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে এসে ৫ নম্বর ক্যাম্পে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন।
জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেন যে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করায় ওস্তাদ খালেদের নির্দেশে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তিনি মূল পরিকল্পনাকারী। তাছাড়া মতাদর্শিক দ্বন্দ্বে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর সেভেন মার্ডারেও তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও ২০২২ সালে গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাবের মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় আরসা সন্ত্রাসীদের হামলায় গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন। ওই সন্ত্রাসী হামলায় একজন র্যাব সদস্য গুরুতর আহত হন।
এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে কক্সবাজারের উখিয়া থানায় ১৩টি হত্যা, একটি অস্ত্র, দুটি অপহরণ, দুটি এসল্ট, একটি ডাকাতি এবং বিস্ফোরক আইনে একটি মামলাসহ বিভিন্ন অপরাধে সর্বমোট ২১টি মামলা রয়েছে। গ্রেফতার অপর চারজনও আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী। তাদের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে।
গ্রেফতারের পর মামলা করে উখিয়া থানায় হস্তান্তরের তথ্য জানিয়ে র্যাবের অধিনায়ক বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন কারণে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে ২০২৩ সালে ৬৪ জন এবং ২০২৪ সালের এখন পর্যন্ত ২০ জন নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর জের ধরে র্যাব অভিযান চালিয়ে ১১২ জন আরসা শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
এ পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে ৫১.৭১ কেজি বিস্ফোরক, ৫টি গ্রেনেড, ৩টি রাইফেল গ্রেনেড, ১০টি দেশীয় তৈরি হ্যান্ড গ্রেনেড, ১৩টি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ৫৪টি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, ১৬৮ রাউন্ড গুলি/কার্তুজ, ৬৭ রাউন্ড খালি খোসা, ৪টি আইডি ও ৪৮টি ককটেল উদ্ধার করা হয়।