জাতীয় ডেস্ক:
গাজীপুরে রেলে নাশকতার ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী সিটি করপোরেশনের এক কাউন্সিলরসহ সাতজনকে গ্রেফতার করেছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ।
শুক্রবার ও শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন, সিটি করপোরেশনের ২৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান আজমল ভূঁইয়া, গাজীপুর মহানগর ২৮ নং ওয়ার্ডের রফিকের বাড়ির ভাড়াটিয়া জান্নাতুল ইসলাম (২৩), ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানার বান্দীয়া গ্রামের তাইজুদ্দীনের ছেলে মেহেদী হাসান (২৫), মহানগরীর ২৪নং ওয়ার্ডের তরিকুল ইসলামের ছেলে জুলকার নাইন আশরাফি ও হৃদয়, সদর থানার কানাইয়া এলাকার মৃত সোলায়মান মোড়লের ছেলে শাহানুর আলম (৫৩), একই এলাকার মৃত ওমেদ আলী মোল্লার ছেলে মো. সাইদুল ইসলাম (৩২), মধ্য ছায়াবীথি এলাকার আফতাফ উদ্দিন এর ছেলে সোহেল রানা (৩৮)।
রোববার (১৭ ডিসেম্বর) দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান গাজীপুর মেট্রপলিটন পুলিশ কমিশনার মাহবুব ইসলাম।
তিনি জানান, একটি নাশকতার মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে যে, একদল দুষ্কৃতকারী গত বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) ভোর ৩ টা থেকে ৪ টার দিকে শ্রীপুর উপজেলার প্রহল্লাদপুর ইউনিয়নের বনখরিয়া চিলাই রেল ব্রিজের পাশে রেল লাইন কেটে ফেলে। এরফলে মোহনগঞ্জ-ঢাকাগামী ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এতে ট্রেনটির ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে একজন নিহত হয় এবং দশ জন গুরুতর আহত হন। পরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে পুলিশ দুষ্কৃতকারী দলের সদস্য জান্নাতুল ইসলামকে ও মেহেদী হাসা কে আটক করে।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, উক্ত ঘটনা ঘটাবার উদ্দেশ্যে তারা গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার পরে মহানগরীর কোনাবাড়ী থেকে একটি হায়েস গাড়ি ঢাকা যাওয়ার কথা বলে ভাড়া করে। তারা ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে ঢাকা যাওয়ার কথা থাকলেও ঢাকায় না গিয়ে গাজীপুরের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করতে থাকে। আরোহীদের সবােই মুখোশ পরা অবস্থায় ছিল। এ অবস্থায় ড্রাইভার ভয় পেয়ে তাদের ঢাকায় না যাওয়া এবং মুখোশ পরার কারণ জিজ্ঞেস করলে তাদের মধ্যে একজন মুখোশ খোলে ড্রাইভারকে তার চেহারা দেখায় এবং বলে, ‘দেখো আমাকে তুমি চিনো কিনা?’
তারপর ড্রাইভার তাকে চিনতে পেরে আর কিছু বলে না। উক্ত ভাড়াকৃত গাড়ি নিয়ে তারা রেল লাইন কেটে নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যে বের হয়। পথিমথ্যে তারা শিববাড়ী, জোড় পুকুরপাড়সহ আরও বিভিন্ন স্থান থেকে বেশ কয়েকজনকে গাড়িতে ওঠায়।
তারা গাজীপুর মহানগরীর জোড় পুকুর এলাকার ইবনে সিনহা তোহার বাড়ি থেকে রেল লাইন কাটার যন্ত্রপাতি এবং দক্ষিণ সালনা উসমান গণির ভাড়া দেওয়া ‘বাঁশ বাগান’ রেস্টুেরেন্ট থেকে দুইটি গ্যাস সিলিন্ডার গাড়িতে ওঠায়। এসব সরঞ্জামাদিসহ তারা শিববাড়ী মোড় থেকে দুইজন ব্যক্তিকে উক্ত গাড়িতে ওঠায়। তারপরে গাজীপুর শহরের ভিতরে বিভিন্ন অলি গলিতে ঘোরাঘুরি করে রাত ১০টার দিকে শিমুলতলী হান্ডী বিরানীতে খাওয়াদাওয়া করে এবং রাত ১১ টার দিকে উক্ত হোটেল থেকে বের হয়ে পুনরায় গাড়িতে ওঠে। সময়ক্ষেপণ করার জন্য আবারও শহরের ভিতরে বিভিন্ন অলি গলিতে ঘোরাঘুরি করে।
এরপর আনুমানিক রাত ত টার দিকে বনখরিয়া এলাকায় ঘটনাস্থল থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরত্বে বনের পাশে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে তারা গ্যাস সিলিন্ডারসহ সরঞ্জামাদি নিয়ে বনখরিয়া চিলাই রেল ব্রিজের পাশে যায়। সেখানে গিয়ে তারা একত্রে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এবং সুযোগবুঝে আনুমানিক ভোর ৩ টা থেকে ৪ টার মধ্যে তারা ২০ ফিট রেল লাইন কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এরফলে ভোর আনুমানিক সোয়া চারটার দিকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঘটনাস্থলে পৌঁছালে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
এ ঘটনা ঘটিয়ে তারা গাড়ি নিয়ে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকায় গিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে ৪ জন গাড়ি থেকে নেমে যায় এবং বাকি সদস্যরা পরবর্তীতে মিরপুরে গিয়ে নামে। মিরপুরে নেমে তারা নিজেদের কাছে টাকা না থাকায় একজনকে ফোনে বলে যে, ড্রাইভারকে তার ফোন নম্বরের বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দাও। সেই মোতাবেক জনৈক এক ব্যাক্তি ডাইভার সাইফুলের ফোন নম্বরের বিকাশে ৮,১০০ টাকা পাঠিয়ে দেয়। এরপরই গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের বিভিন্ন টিম গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্নস্থানে অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
পরে আটককৃত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গত ১১ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ২৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সাবেক বিএনপি নেতা আজমল ভূঁইয়ার বাসাসহ বিভিন্নস্থানে তার সভাপতিত্বে মিটিং হয়। উক্ত মিটিংয়ে রেল লাইন কেটে নাশকতা ঘটানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত এবং পরিকল্পনা করা হয়। উক্ত মিটিং এ আলোচনা হয় যে, দলীয় উচ্চ পর্যায় থেকে বড় কিছু করার চাপ আছে; বড় কোনো ঘটনা ঘটলে দেশ ও বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হবে বিধায় তারা রেল লাইনে নাশকতা ঘটানোর পরিকল্পনা করে। সরকারের বর্তমান নির্বাচনী কার্যক্রমকে বিতর্কিত করা, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমানে বিরাজমান রাষ্ট্রীয় সু-শৃঙ্খল পরিবেশকে নষ্ট করা, জনমনে ভীতি সঞ্চার করা এবং এর মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজ, হরতাল-অবরোধ সফল করার জন্য ব্যাপক প্রাণহানির ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য রেললাইনকে বেছে নেয়া হয়েছিল। যা দেশ ও বিদেশে আলোড়ন তৈরি করতে পারে। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিগত রেল লাইন কেটে এর বাস্তবায়ন ঘটায়।
এ ঘটনার কাজে ব্যবহৃত মাইক্রোবাস উদ্ধার করা হয়েছে। মাইক্রোবাসের চালক ঘটনার সঙ্গে সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে এবং নাশকতার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার ও অন্যান্য জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে এবং এর প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীও পাওয়া গেছে।