নিউজ ডেস্ক:
যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্কহার দ্বিগুণ হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন মোড় সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির জেরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন। ফলে ভারতের কিছু পণ্যে মোট শুল্কহার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত ভারতের জন্য বড় ধরনের বাণিজ্যিক ধাক্কা হলেও বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বিরল রফতানি ও বিনিয়োগ সম্ভাবনার জানালা খুলে দিয়েছে। কৌশলগত প্রস্তুতির মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু মার্কিন বাজারেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ রফতানিকারক দেশ হিসেবেও নিজেদের অবস্থান আরও মজবুত করতে পারে।
ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক বিঘ্নিত হয়েছে জিএম খাদ্যপণ্য, দুগ্ধজাত পণ্য ও কৃষিনীতির জটিলতায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যচুক্তি ভারতের প্রতিযোগিতা আরও কঠিন করে তুলেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের ওপর দ্বিগুণ শুল্কের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য একটি কৌশলগত সুযোগ। তবে এই সুযোগ চিরস্থায়ী নয়। এখনই সময় কার্যকর রোডম্যাপ প্রণয়ন, দ্রুত প্রস্তুতি এবং সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের। তা না হলে সম্ভাবনার এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
সুযোগ বাংলাদেশের
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের তৈরি পোশাক খাত বড় ধরনের ধাক্কার মুখে পড়তে যাচ্ছে। সরকারিভাবে দেশটির পোশাকপণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ভারতীয় রফতানি মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে। ফলে আমদানিকারকরা বিকল্প উৎস— বিশেষ করে শুল্কছাড়প্রাপ্ত বা নিম্ন শুল্ক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশগুলোর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবেন।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ভারত ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৩.০২ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করলেও তা বেড়ে ২০২৪ সালে ৪.৭০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। এই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৫.৩৪ শতাংশ। বিশ্লেষকদের মতে, ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে ভারতীয় পণ্যের প্রতিযোগিতামূল্য হ্রাস পাবে এবং বাজার হারানোর ঝুঁকি বাড়বে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ইতোমধ্যেই জনপ্রিয়। ভারতের অনুপস্থিতি কিংবা দুর্বলতা বাংলাদেশের বাজার দখলের সুযোগ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে মান, সময়ানুবর্তিতা, ক্রয়মূল্য এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমেরিকার বাজারে আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। তারা চীনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মার্কিন বাজারে ভালো অবস্থান তৈরি করেছিল। কিন্তু নতুন শুল্ক নীতির ফলে বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল সম্ভাবনার দরজা খুলেছে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের রফতানি খাত যে কোনও সময়ের চেয়ে এখন ভালো যাবে।”
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি ঊর্ধ্বমুখী
বাংলাদেশের রফতানির প্রায় ৮০ শতাংশই তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে, যার সবচেয়ে বড় একক বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পোশাক রফতানি বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ, আর চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই রফতানির প্রবৃদ্ধি ২১ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় পোশাকের প্রতিযোগিতামূলক মূল্য ধরে রাখা কঠিন হবে। যেখানে বাংলাদেশের ওপর শুল্কহার রয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ— এই ব্যবধানই মার্কিন আমদানিকারকদের চোখে বাংলাদেশকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলছে।
বাংলাদেশি পণ্যের আকর্ষণ বাড়ছে
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ইতোমধ্যেই জনপ্রিয়। বর্তমানে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পোশাক রফতানিতে গড় শুল্কহার ২০ শতাংশ। অতিরিক্ত ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্কসহ মোট শুল্কহার দাঁড়ায় ৩৬.৫ শতাংশ, যা ভারতের ৫০ শতাংশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে আনা হয়েছে, তবে এতে একটি শর্তও যুক্ত হয়েছে— যদি রফতানিকৃত পোশাকে কমপক্ষে ২০ শতাংশ আমেরিকান কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়, তবে সেটি শুল্কমুক্ত থাকবে।
বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের প্রায় ৭৫ শতাংশই তুলার তৈরি হলেও এই তুলা মূলত আসে আমেরিকার বাইরের দেশ থেকে। ফলে আমেরিকান তুলা আমদানির হার বাড়ানো গেলে শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ সহজ হবে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) জানিয়েছে, বর্তমানে দেশে বছরে ৪০০ কোটি ডলারের তুলা আমদানির প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে মাত্র ৩০ কোটি ডলারের তুলা আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এই পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
চামড়া, কৃষিপণ্য ও আইটি খাতেও সম্ভাবনা
শুধু পোশাক নয়, যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় পণ্যে বাড়তি শুল্কের প্রভাব পড়তে পারে চামড়াজাত পণ্য, কৃষিপণ্য এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও। এই খাতগুলোতেও বাংলাদেশের সামনে রয়েছে সম্ভাবনার দ্বার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের জুতা, ব্যাগ ও অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য ইতোমধ্যেই জার্মানি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বাজারে জায়গা করে নিয়েছে। এবার যুক্তরাষ্ট্রেও প্রবেশের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে মান নিয়ন্ত্রণ ও ব্র্যান্ডেড মার্কেটিং বাড়ানো প্রয়োজন।
অন্যদিকে, হিমায়িত চিংড়ি, মাছ, ফলমূল ও শাকসবজি রফতানিতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মান ও কোল্ড চেইন অবকাঠামো নিশ্চিত করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতের শূন্যতা পূরণ করতে পারবে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও ফ্রিল্যান্সিং খাতেও ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত হচ্ছে। খরচ কম, দক্ষ মানবসম্পদ এবং দ্রুত প্রসারমান ফ্রিল্যান্সিং ইকোসিস্টেম বাংলাদেশের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলেছে।
বিনিয়োগ আকর্ষণে নতুন সুযোগ
বিশ্বব্যাপী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন ‘চীন-প্লাস ওয়ান’ নীতির আওতায় উৎপাদন কেন্দ্র বিকেন্দ্রীকরণ করছে। ভারতের ওপর শুল্ক বাড়ায় বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে নতুন ‘ভবিষ্যৎ ঘাঁটি’। দক্ষ শ্রমিক, সাশ্রয়ী উৎপাদন ব্যয় এবং ক্রমোন্নত অবকাঠামো বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করছে।
এই সুযোগ কাজে না লাগালে ভুল করবে বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের ওপর শুল্ক দ্বিগুণ হওয়ার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য একটি স্ট্র্যাটেজিক উইন্ডো অব অপরচুনিটি তৈরি করেছে। তবে এই সুযোগ স্থায়ী নয়। দ্রুত সিদ্ধান্ত, বাস্তবভিত্তিক প্রস্তুতি ও যৌথ কৌশল ছাড়া এ সম্ভাবনা মিস হয়ে যেতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তেই কার্যকর রোডম্যাপ তৈরি করে এগোলে শুধু মার্কিন বাজারেই নয়, বৈশ্বিক রপ্তানি ও বিনিয়োগ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের স্থান একধাপ উপরে উঠে যেতে পারে।
চ্যালেঞ্জও কম নয়
যদিও সম্ভাবনা অনেক, তবে প্রতিযোগিতাও তীব্র। ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন এই অবস্থায় বাংলাদেশকে—
১. উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে,
২. মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে,
৩. রফতানি লজিস্টিকস ও বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে হবে,
৪. ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে উন্নতি করতে হবে,
৫. সরকার ও বেসরকারি খাতের সমন্বয় জোরদার করতে হবে।