হোম জাতীয় যুক্তরাজ্য-ভার‌ত বা‌ণিজ্য চু‌ক্তি, বাংলাদেশের হাতছাড়া সুযোগ ও ড. ইউনূসের সফর

যুক্তরাজ্য-ভার‌ত বা‌ণিজ্য চু‌ক্তি, বাংলাদেশের হাতছাড়া সুযোগ ও ড. ইউনূসের সফর

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 35 ভিউজ

অনলাইন ডেস্ক:
যুক্তরাজ‌্য সরকার এই মুহূ‌র্তে ভারতের সঙ্গে উন্মোচিত হওয়া একটি বাণিজ্য চুক্তির জেরে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিরোধীরা যুক্তি দিচ্ছেন, এই চুক্তি ব্রিটিশ কর্মীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। নতুন তথ্য অনুযায়ী, চুক্তিটির মধ্যে থাকা ‘দ্বৈত অবদান কনভেনশন’ (ডিসিসি) ভারতীয় নাগরিকদের ব্রিটিশ সমকক্ষদের চেয়ে হাজার হাজার পাউন্ড কম খরচে নিয়োগের সুযোগ করে দিতে পারে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে। এর ফলে চাকরিচ্যুতি এবং একটি ‘দুই-স্তরের’ কর্মসংস্থান ব্যবস্থার আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এই চুক্তিকে ব্রিটেনের জন্য একটি বড় অর্থনৈতিক উদ্দীপক হিসেবে প্রশংসা করলেও, ব্রিটিশ কর্মসংস্থানের জন্য এর লুকানো খরচ এখন সামনে আসছে। ভারতীয় কর্মীদের যারা যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত হচ্ছেন, ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কন্ট্রিবিউশন পরিশোধ করা থেকে তাদের ব্যবসাগুলোকে অব্যাহতি দিচ্ছে ডিসিসি। এই ছাড় ভারতীয় মেধাবী জনশ‌ক্তি আমদানি করা সংস্থাগুলোর জন্য যথেষ্ট কর কমানোর সুযোগ তৈরি করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, দিল্লি থেকে একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে নিযুক্ত করা একটি ব্যবসা ডনকাস্টার থেকে একজন ব্রিটিশ সমকক্ষ নিয়োগের তুলনায় ১১ হাজার ১৬৮ পাউন্ড পর্যন্ত কর সাশ্রয় করতে পারে।

ব্রিটে‌নের ছায়া ব্যবসা ও বাণিজ্য বিষয়ক সচিব অ্যান্ড্রু গ্রিফিথ এই ফলাফলকে নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ‘ভারতীয় সেকেন্ডিদের জন্য লেবারের দুই-স্তরের কর ছাড় কঠোর পরিশ্রমী ব্রিটিশদের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। এর অর্থ ব্রিটিশ কর্মীদের জন্য কম সুযোগ এবং কম বেতন। কিয়ার আমাদের দেশের পক্ষে দাঁড়াবেন না এবং ব্রিটিশ জনগণের জন্য কিছু করতে পারবেন না, ব্রিটেনের এর চেয়ে ভালো কিছু প্রাপ্য।’

আরেকটি উদ্বেগজনক উদাহরণে দেখা গেছে, একটি ভারতীয় সংস্থা বেঙ্গালুরু থেকে একজন আইটি উপদেষ্টা নিয়ে এসে বার্মিংহাম থেকে একই দক্ষতাসম্পন্ন কাউকে নিয়োগের চেয়ে ৭ হাজার ২১১ পাউন্ড পর্যন্ত সাশ্রয় করছে। এই বৈষম্যের প্রধান কারণ হলো গড় বেতনের বিশাল পার্থক্য; ভারতে একজন আইটি উপদেষ্টা বছরে প্রায় ১২ হাজার পাউন্ড উপার্জন করতে পারেন, যেখানে ব্রিটেনে তা ৫২ হাজার পাউন্ড। অভিবাসী স্বাস্থ্য সারচার্জ বিবেচনা করার পরেও, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো একজন ভারতীয় কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে ৬ হাজার পাউন্ডের বেশি সাশ্রয় করতে পারে।

বিতর্কে যোগ হয়েছে, কিছু নিয়োগকর্তা হতাশা প্রকাশ করেছেন যে ব্রিটিশ কর্মীরা নির্দিষ্ট কিছু কাজ করতে ক্রমবর্ধমানভাবে অনিচ্ছুক, যা অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে এবং সম্ভাব্য বিদেশী কর্মী নিয়োগে উৎসাহিত করছে। এদিকে, ভারত সরকার ডিসিসি চুক্তিকে একটি ‘বড় জয়’ এবং ‘অভূতপূর্ব অর্জন’ হিসেবে প্রশংসা করে খোলাখুলিভাবে ঘোষণা করেছে এটি ‘যুক্তরাজ্যে ভারতীয় পরিষেবা প্রদানকারীদের উল্লেখযোগ্যভাবে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে।’

উল্লেখযোগ্য কর ছাড় ছাড়াও, স্বরাষ্ট্র দফতর ভারতীয় শেফ, শিক্ষক এবং সংগীতজ্ঞদের পাশাপাশি তাদের নির্ভরশীলদেরও অপরিহার্য কর্মীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা ভারতীয় কর্মীদের সম্ভাব্য আগমনকে আরও বিস্তৃত করছে।

য‌দিও সরকারের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ভারতীয় নাগরিকরা কর ছাড় পাবেন না এবং চুক্তিটি স্বল্প সংখ্যক অত্যন্ত দক্ষ, উচ্চ বেতনের পেশাদারদের জন্য অস্থায়ী ভিসায় সীমাবদ্ধ। যে বাণিজ্য চুক্তি ব্রিটিশ অর্থনীতিকে ৪.৮ বিলিয়ন পাউন্ড বৃদ্ধি করবে এবং বছরে ২.২ বিলিয়ন পাউন্ড মজুরি বৃদ্ধি করবে। তবে, সমালোচকরা তা‌তে বিশ্বাস না করে ব্রিটিশ জনগণের কর্মসংস্থানের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের আশঙ্কা করছেন।

ব্রিটে‌ন ভারত চু‌ক্তি ব্রিটিশ কর্মীদের জন্য বড় শঙ্কার কারণ হতে পারে

বাংলাদেশের হাতছাড়া হওয়া সুযোগ ও নতুন সম্ভাবনা

ভার‌তের সঙ্গে চু‌ক্তি নি‌য়ে চল‌তি বিতর্কের মধ্যে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উঠে আসে, কমনওয়েলথভুক্ত এবং যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্কযুক্ত একটি দেশ, যার বিশাল দক্ষ শ্রমশক্তি রয়েছে, সেই বাংলাদেশ কেন একইরকম একটি সুবিধাজনক বাণিজ্য চুক্তি নিশ্চিত করতে পারেনি? উত্তর হলো দেশ‌টির অভ্যন্তরীণ সরকারি নিষ্ক্রিয়তা এবং কৌশলগত কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক আলোচনায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে ব্যর্থতা। ব্রিটে‌নে দক্ষ জনশ‌ক্তি পাঠা‌তে কোনও উদ্যোগ না নি‌য়ে গত শেখ হা‌সিনা সরকার বাংলা‌দেশি ব‌্যর্থ এসাইলাম আবেদনকারী‌দের দ্রুত বাংলা‌দে‌শে ফেরত নি‌তে এক‌টি চু‌ক্তি ক‌রে।

লন্ডনে বাংলাদে‌শের গত সরকারগু‌লোর আম‌লে রাজ‌নৈ‌তিক সমর্থন আদা‌য়ের বাইরে দে‌শের সাম‌গ্রিক উন্নয়‌নে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উপস্থিতি ধারাবাহিকভাবে শক্তিশালী ছিল না, এমন অভিযোগ র‌য়ে‌ছে। ভ‌ারতীয়‌দের ম‌তো এমন অনুকূল শর্ত নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় লবিং এবং আলোচনা কৌশলের অভাব দেখা গেছে। ভারতের মতো, যার একটি শক্তিশালী এবং সুসম্পন্ন কূটনৈতিক কর্পস বিশ্বব্যাপী তার অর্থনৈতিক স্বার্থ সক্রিয়ভাবে অনুসরণ করছে, বাংলাদেশের সরকার কখনও কখনও এই ধরনের সুযোগগুলো কাজে লাগানোর জন্য দূরদর্শিতা এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টার অভাব দেখিয়েছে। ফলে নাগরিকদের জন্য ব্রিটে‌নে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো ‘হাতছাড়া হয়ে গেছে’। একটি শক্তিশালী, সক্রিয় অর্থনৈতিক কূটনীতি কৌশলের অনুপস্থিতি মানে ভারত তার পরিষেবা প্রদানকারীদের জন্য একটি ‘বড় জয়’ অর্জন করলেও, বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তীই রয়ে গেছে, তার সম্ভাব্য কর্মশক্তি একইরকম অগ্রাধিকারমূলক আচরণ থেকে উপকৃত হতে পারেনি। এই উদ্যোগের অভাব বাংলাদেশকে মূল্যবান অর্থনৈতিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে এবং তার নাগরিকদের অনুকূল শর্তে লাভজনক যুক্তরাজ্যের চাকরির বাজারে প্রবেশ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস সোমবার (৯ জুন) যুক্তরাজ্য সফর করবেন এবং কিং চার্লসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। সফরটি বাংলাদেশের জন্য এ বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য সুযোগ তৈরি করতে পারে।

সফরকালে ড. ইউনূসের উচিত অর্থনৈতিক কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া। রাজার সঙ্গে সাক্ষাতের সময়, তাকে দৃঢ়ভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক, বিশেষ করে শ্রম গতিশীলতা এবং বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গভীর আগ্রহের কথা জানাতে হবে, একটি ‘দ্বৈত অবদান কনভেনশন’ বা অনুরূপ কাঠামোর জন্য বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে হবে। তাকে বাংলাদেশে একটি দক্ষ ও অভিযোজনযোগ্য কর্মশক্তির সহজলভ্যতা তুলে ধরতে হবে, বিশেষ করে যেসব খাতে যুক্তরাজ্যে শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে, যেমন স্বাস্থ্যসেবা, আইটি, আতিথেয়তা এবং বাংলাদেশি শ্রমের গুণমান ও ব্যয়-কার্যকারিতার তথ্য উপস্থাপন করতে হবে। ড. ইউনূসের একটি ব্যাপক বাণিজ্য ও শ্রম গতিশীলতা চুক্তির ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি নিবেদিত দ্বিপাক্ষিক আলোচনার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়া উচিত, যা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি গুরুতর প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করবে। যেকোনও ব্রিটিশ উদ্বেগ দূর করতে, তাকে পরোক্ষভাবে যুক্তরাজ্যের প্রতি বাংলাদেশের সুশাসন, ন্যায্য শ্রম অনুশীলন এবং ভবিষ্যতে যেকোনও চুক্তির জন্য স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করতে হবে, সম্ভাব্য শোষণ রোধ এবং নৈতিক নিয়োগ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। পরিশেষে, যদিও রাজার ভূমিকা মূলত আনুষ্ঠানিক, তবুও ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রতি তার সমর্থন একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে পারে এবং ব্রিটিশ সরকারকে বাংলাদেশি প্রস্তাবগুলো আরও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে উৎসাহিত করতে পারে। ব্রিটিশ মন্ত্রী‌দের সঙ্গে সম্ভাব‌্য বৈঠ‌কেও এ বিষয়গু‌লো নি‌য়ে অর্থবহ ও প‌রিকল্পিত আলোচনার সু‌যোগ নি‌তে পা‌রেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।

ড. ইউনূসের নি‌জের ক‌্যা‌রিশমা এবং কমনওয়েলথ সংযোগকে কাজে লাগিয়ে উন্নত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য রাজার ও সরকা‌রের সমর্থন আদায় করা উচিত। যদি তার সফরকালে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে এমন একটি ঘোষণা আদায় করতে পারেন, যা বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, গবেষক এবং কর্মীদের জন্য বিশেষ সুবিধার প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে তা তার জন্য একটি অভূতপূর্ব সাফল্য হবে।

এদি‌কে প্রধান উপদেষ্টা তার সফরকালে কোন কোন ব্রিটিশ মন্ত্রী‌দের সঙ্গে সাক্ষাৎ কর‌বেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হ‌বে কিনা তা এখ‌নও নি‌শ্চিত হওয়া যায়‌নি।

এ ব‌্যাপারে জান‌তে চাইলে লন্ড‌নে বাংলা‌দেশ হাইক‌মিশ‌নে নিযুক্ত প্রেস সে‌ক্রেটারি রবিবার (৮ জুন) বি‌কা‌লে বাংলা ট্রিবিউন‌কে ব‌লেন, ‘সফরসূচি এখ‌নও চূড়ান্ত হয়নি।’

সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ ইউকে’র আহ্বায়ক নসরুল্লাহ খান জুনায়েদ ব‌লেন, ‘ড. ইউনূ‌সের সফ‌রে বাংলাদেশি‌দের সঙ্গে মত‌বিনিময় ও নাগ‌রিক সংবর্ধনা বা‌তি‌লে এক‌টি পক্ষ কাজ ক‌রে‌ছে। এ সফ‌রে পুরস্কার গ্রহণ ও রু‌টিন কার্যক্রমের বাইরে বাংলা‌দে‌শের অর্থনৈ‌তিক অগ্রযাত্রার জ‌ন‌্য প্রধান উপ‌দেষ্টা য‌দি ব্রিটিশ সরকা‌রের পক্ষ থে‌কে কোনও আশাব‌্যঞ্জক প্রতিশ্রুতি আদায় কর‌তে পা‌রেন, ত‌বে সে‌টি হ‌বে তার কূট‌নৈতিক সাফ‌ল্যের নতুন মাইলফলক।’

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন