মণিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি :
যশোরের মণিরামপুর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের ৫টি ইউনিয়নে কৃষকের স্বপ্ন দোলাচলে। একদিকে মাঠে কৃষকের সোঁনালী স্বপ্ন, অন্যদিকে বিস্তীর্ণ জলরাশিতে দুঃস্বপ্নের হাতছানি দিচ্ছে। ভবদহ স্লুইচ গেটের কারণে মণিরামপুর উপজেলার নেহালপুর, কুলটিয়া, দুর্বাডাঙ্গা, মনোহরপুর ও হরিদাসকাটি ইউনিয়নের বেশিরভাগ জমিতে বোরো আবাদ হয়নি। যতটুকু আবাদ হয়েছে, সেই ফসল ঘরে তোলা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। যশোর কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর জানায়, কেশবপুর, মণিরামপুর ও অভয়নগর উপজেলার ভবদহ অঞ্চলে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়। জলাবদ্ধতার কারণে ওই অংশে এবার ৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হচ্ছে না। এর মধ্যে মণিরামপুর উপজেলায় দুই-তৃতীয়াংশ জমি ওই ৫টি ইউনিয়নের। মণিরামপুর উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, ভবদহ অঞ্চলের সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে উপজেলার ভবদহ অংশে ১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে এবার বোরো চাষ হয়নি। তবে কৃষকেরা কৃষি দপ্তরের এই হিসাবের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না। তাদের দাবি, এবার ভবদহের নদী দিয়ে এক ফোঁটা পানি সরেনি। তাই কৃষি অফিসের হিসাবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি জমিতে বোরো আবাদ হয়নি।
জানা যায়, যশোরের অভয়নগর, মণিরামপুর, কেশবপুর ও সদর উপজেলার আংশিক, খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। ২০১৩ সালের পর থেকে এলাকার কোনো বিলে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট-জোয়ারাধার) চালু না থাকায় পলি পড়ে এই অঞ্চলের ৫৪টি বিলের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদীর বুকে পলি পড়ে নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে নদী দিয়ে এই এলাকার পানি সরছে না। আর এ কারণে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পানিতে তলিয়ে যায় প্রায় ৪৮৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা। আর এই বিস্তীর্ণ এলাকার একটি বড় অংশ হচ্ছে ওই পাঁচটি ইউনিয়ন। সোমবার ভবদহ অঞ্চলের কিছু এলাকা সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বিলগুলোয় শুধুই অথই পানি। বিল কেদারিয়া, বিলবোকড়, বিলডুমুর, বিল ঝিকরা, বিলকপালিয়া এবং বিল খুকশিয়ার অধিকাংশ এলাকায় কোনো ধানক্ষেত নেই। বিলগুলো কেবল শাপলা আর আগাছায় ভরে আছে। কোথাও কোথাও আবার স্বচ্ছ পানি। তবে বিল ঝিকরা, বিল কেদারিয়া ও বিল খুকশিয়ার ওপরের অংশে কিছু ধানক্ষেত দেখা গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জলাবদ্ধতা নিষ্কাশনের জন্য ভবদহ সøুইস গেটের (২১ ভেন্ট) ওপর বিএডিসির সহায়তায় ৬০ লক্ষ টাকা ব্যয়ের প্রকল্পে ১৩টি বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র বসিয়ে পানি সেচ দিচ্ছে। কিন্তু নদীতে পানি না থাকায় অধিকাংশ সময় সেচযন্ত্রগুলো বন্ধ থাকতে দেখা গেছে।
সরোজমিনে আরও জানা যায়, ভবদহ এলাকার বিল বোকড়, বিল কেদারিয়া, বিল কপালিয়া, বিল আড়পোতা, বিল জিয়ালদহ, বিল ডুমুর, বিল ভূষনোসহ ছোট-বড় ১০টি বিলের প্রায় ৬০শতাংশ জমিতে এবার বোরো আবাদ হয়নি। তবে অপেক্ষাকৃত উচু কয়েকটি বিলে নিজস্ব উদ্যোগে সেচযন্ত্র দিয়ে মৎস্য ঘেরের পানি পাম্প করে তার ভিতর বোরো আবাদ করা হয়েছে। সেখানে কৃষকের মুখে হাসি, হৃদয়ে সোঁনালী স্বপ্ন। অন্যদিকে বিস্তীর্ণ জলরাশিতে ভরে আছে অধিকাংশ বিল। কৃষকেরা আছে দুঃস্বপ্নে। আগামী বছরও জমিতে ধান চাষ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। উপজেলার হরিদাসকাটি ইউনিয়নের কৃষক অসীম কুমার ধরের বিলডুমুরে জমি আছে পৌনে আট একর। গত বোরো মৌসুমে সেচযন্ত্র দিয়ে সেচে ২ একর ৪ শতক জমিতে তিনি বোরো ধানের চাষ করেছিলেন। ভবদহ অঞ্চলের বিলের ওইসব জমি এবার পানির তলে। তাই তিনি এবার একটি ধানের চারাও লাগাতে পারেননি। অসীম কুমার ধর বলেন, ‘এহনও বিলের জমিতি, মাজা (কোমর) জল জাগায় জাগায় বুক পর্যন্ত জল। জলাবদ্ধতার জন্য এবার কোনো জমিতি ইরি (বোরো) লাগাতি পারিনি।’
অসীম কুমার ধরের মতো ভবদহ এলাকার হাজার হাজার কৃষক জলাবদ্ধতার জন্য এবার বোরো আবাদ করতে পারেননি। মনোহরপুর ইউনিয়নের কৃষক জগদীশ জানান, ভেবেছিলাম ভবদহের সেচপাম্প দিয়ে হয়তো বিলের অধিকাংশ জমিতে বোরো আবাদ করতে পারবো। কিন্তু সেটি আর হলো না। অর্ধেক জমিই চাষ করতে পারলাম না। কুলটিয়া ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন কৃষকের সাথে আলাপকালে জানা যায়, তারা একখন্ড জমিতেও এবার বোরো ধান চাষ করতে পারেননি। আশেপাশের সব বিলেই একই অবস্থা। পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে আগামী বছরও তারা ধান চাষ করতে পারবে না বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন।