মণিরামপুর (যশোর)প্রতিনিধি :
ঘুর এলাম যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীর ফুলপুরিতে। উপজেলার একটি সুপরিচিত নাম গদখালী। গদখালী ঝিকরগাছা উপজেলার একটি ইউনিয়ন। মুলত উপজেলঅ গদখালী ও পানিসারা ইউনিয়নের নারাঙ্গালী, বল্লা, গদখালী, পানিসারা, বাইসা, চানপুর,নীলকন্ঠসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রাম নিয়ে এ ফুলের রাজ্য অর্থ্যাৎ ফুলপুরি।
এখানকার হাজার-হাজার একর জমিতে বছর জুড়ে উৎপাদিত হয় দেশি-বিদেশী বিভিন্ন প্রকারের হরেক জাতের ফুল।এলাকাটিকে ফুলের নগরী বললে মানানসই হবে বলে আমারমত অনেকেই বিশ্বাস বিশ্বাস করে। এলাকাটির চারিদিকে ফুল আর ফুল। স্থানীয় জনসাধারণের বাস্তভিটা টুকু বাদ দিলে বাকী সবখানেই রূপকথা রাজ্যের ফুল বাগিচার মত মনে হবে। জারবেরা, গ্লাডিওলাস, গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা, কামিনীসহ জানা-অজানা অনেক রকমের ফুলের বাগান।
যশোর শহর থেকে বেনাপোল বর্ডারের দিকে ঝিকরগাছা পৌরশহর থেকে ৫/৬ কিলোমিটিার পশ্চিমে গদখালি বাজার। এটা মুলত ফুলের বাজার হিসেবে পরিচিত। এলাকার চাষকৃত ফুলসমুহ এ বাজারেই বেঁচাকেনা হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারী ফুল ক্রেতারা এখান ফুল ক্রয় করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলাতে বিক্রিয়ের জন্য নিয়ে যায়। এমনকি এখানকার ফুল বিদেশেও রপ্তানী হয়।
অপরূপ-রূপের বাহারে সমৃদ্ধ এ ফুলপুরিতে যে একবার আগমণ করেছেন, তিনিই এ ফুলপুরির প্রেমে পড়ে যাবেন। বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত অথবা অপরিচিত কারও ফুলপুরি অবলকন করে ঘুরে এসে তার অপরূপ দৃশ্যের বর্ণনা যদি কেউ করে থাকে তবে-পাগল ও প্রতিবন্ধী ব্যতিত প্রত্যেকেরই অবশ্যই এখানে একবার দেখে আসতে মন চাইবে। আমিও শুনেছিলাম এই ফুলপুরির কথা।
তাই আমারও শখ বা সাধ জেগে উঠেছিলো গদখালি/ পানিসারা এলাকার এই ফুলপুরির ফুলের সৌন্দর্য নিজ চোখে দেখার জন্য। তাই নিজ কর্মের ভিতরে একটু সুযোগ খুজছিলাম সেখানকার ফুলের বাগানের টাটকা সৌরভ গ্রহণ করার। যথারীতি সুযোগ এসে গেলো। আমারমত কয়েকজন শিক্ষাকতা পেশায় নিয়োজিত সিনিয়র-জুনিয়র মিলে প্রতিদিন রাত ৮টার পর চায়ের আড্ডায় মিলিত হয়।
এটা মণিরামপুর পৌর এলাকার গাংড়া-মোল্যাপাড়ার মোড়ের বজলুর চায়ের দোকান। ১৮ নভেম্বর বুধবার রাত ৯টার দিকে আমরা কয়েকজন বসে বজলুর চায়ের দোকানে বসে চায়ের আড্ডায় মেতে উঠেছি।
চলছে আমাদের নিয়মিত আলোচনা-শিক্ষার্থীদের পাঠদান, পরীক্ষা পদ্ধতি, অনলাইন ক্লাস ও দেশের চলমাণ রাজনীতির প্রেক্ষাপট নিয়ে। আলোচনার এক ফাঁকে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সফরের বিষয়টি উঠে আসতেই আড্ডার নিয়মিত সদস্য সুন্দলপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শরিফুল ইসলাম গদখালির ফুলের নগরী পরিদর্শনের প্রস্তাব দিল। এতে সাথে-সাথে উল্লাসিত হয়ে লাউড়ি কামিল মাদ্রাসার ইংরেজি প্রভাষক এনামুল ইসলাম ফুরপুরিতে যাবার জন্য জোর দাবী জানালো।
আমাদের আড্ডার নিয়মিত সদস্য ও মধ্যমণি আমাদের সকলের সিনিয়র মুক্তেশ্বরী ডিগ্রী কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রবীর কুমার রায় চৌধুরীর কাছে পরেরদিনই গলখালিতে যাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করলাম। তিনি একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন। এবার আমার পালা। পরেরদিন আমার গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ থাকা সত্বেও এ সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাইলাম না। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। ঠিক হলো পরেরদিন বৃহষ্পতিবার দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে দ’ুজন করে ৪জন -সকাল ১০টার আগেই ফুলের রাজ্য পরিদর্শনে বের হয়ে পড়বো।
পরেরদিন১৯ নভেম্বর বৃহষ্পতিবার। যথারীতি সকাল ১০টার পর আমরা মোটরসাইকেল যোগে রওনার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ আমার মনে হলো আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু শাহিনের কথা। ওর বাড়ী গদখালীর খুব কাছাকাছি উলসী এলাকায়। আমি তাকে ফোন দিলাম। সে ফোন রিসিভ করলে কুশলাদি আদান-প্রদানের পর আমাদের মূল উদ্দেশ্য জানালাম। সে প্রচন্ড খুশি হয়ে-আগে তার সাথে সাক্ষাত করার জন্য অনুরোধ জানালো। আমরা ৪ জন দুটি মোটরসাইকেলে রওনা দিলাম-মূল উদ্দেশ্য গদখালি ফুলের রাজ্যে।
মণিরামপুর-ঝিকরগাছা সড়ক দিয়ে টেংরামারি বাজার অতিক্রম করে শেখপাড়া রোহিতার মধ্য দিয়ে কোদলাপাড়া মোড়। এরপর রাজগঞ্জ সড়ক হয়ে খেদাপাড়ার আমতলা থেকে গাঙ্গুলিয়া হয়ে মুড়োগাছা বাজার। তারপর কপোতাক্ষের উপর নির্মিত মহতাব নগর ব্রীজ পর হয়ে রঘুনাথনগর মহাবিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে উলশী বাজার। পথিমধ্যে গাঙ্গুলিয়া কপি হাউজে হালকা নাস্তাসহ কপি পান।
একটু দেরি হলেও আমারা যথারীতি শাহিনের সাথে সাক্ষাত করলাম। কিন্তু সে আমাদের ফুলের নগরে নিয়ে গেল না। আগে দুপুরের খাবার খেতে হবে তাই নিয়ে গেল ঝিকরগাছার নাম করা সেই মজিদ ভাইয়ের হোটেলে। আমরাতো হতবাক। সে বললো অনেকদিন পর দেখা আগে খাওয়া-দাওয়া তারপর দেখাদেখি। যাকহোক-ভূড়িভোজটা ভালই দিলাম-কিন্তু সমস্যা একটা হয়ে গেলো আমার।
এনামুল এবং শরিফুলের চাপে পড়ে ভোজটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। ফলে মোটরসাইকেলে চড়তে খুবই সমস্যা হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সেটা কাউকে বুঝতেই দিলাম না। কারণ ফুলের নগরীই তখন শুধু মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে। এরপর ঝিকরগাছা থেকে মাটরসাইকেলে চেপে রওনা থেকে গদখালী। গদখালীর বাজার থেকে আমাদের সেই কাঙ্খিত লক্ষের দিকে।
গদখালী বাজার থেকে বড়জোর ২ মিনিট মত আমরা দক্ষিন দিকে এগিয়ে গেছি। এবার রাস্তার দু’পাশে খেয়াল করলাম কিছু-কিছু জমিতে ফুলের বাগান। এটা মুলত শখের বাগান নয়। ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে ফুলের চাষ করা হয়েছে। যত যাচ্ছি-ততই এটা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকলো। সামনে ছোট একটি মহল্লা পড়লো, সেটি পার হতেই আমার চোখতো ছানাবড়া! আমরা আসল ফুলের রাজ্যে ঢুকে পড়েছি-তার প্রমাণ পেতেও বেশি দেরি হলো না।
রাস্তার দু’পাশে চোখ ও প্রাণ জুড়ানো অসংখ্যা ফুলের বাগান। রাস্তাসহ চারিদিকে ফুলচাষি ও ফুল প্রেমিদের আনাগোনা। মনে হচ্ছিল আমাদেরকে ফুলের রাজ্যে ফুলপরিরা স্বাগত জানাচ্ছে। দুপুরে শেষ দিকে ফুলের নগরী যেন রঙে-ঢঙে সেজেছে। চারিদিকে শুধু ফুল আর ফুল।
মাঠের পর মাঠ সবই ফুল চাষের জমি। কোনটিতে ফুল ধরেছে, কোনটিতে ফুলের কুড়ি আবার কোনটিতে নতুন ফুলের চারা লাগানো হয়েছে। জারবেরা,গ্লাডিওলাস , গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা, অর্কিড, বাতাবাহার প্রভৃতি হরেক রকমের চারা ক্ষেত। যে দিকে তাকাই-চোখে পড়ে একটার পর একটা ফুলের বাগান।কি অপরূপ দৃশ্য! কিছুদূর যেতে চোখে পড়ে ফুল বেচাকেনার খুচরা দোকান।