হোম জাতীয় মানুষ পুড়ে মরে, তবুও বীরদর্পে চলে ওরা

মানুষ পুড়ে মরে, তবুও বীরদর্পে চলে ওরা

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 86 ভিউজ

জাতীয় ডেস্ক:

ভয়াবহ আগুন ও মর্মান্তিক মৃত্যুর পুনরাবৃত্তি আবারও ঘটল রাজধানীতে। ৪৬ মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবন এখন মৃত্যুপুরীর অপর নাম। এ অগ্নিকাণ্ড আরেকবার জানিয়ে দিলো, ঢাকা শহর কতটা অনিরাপদ, কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। আবারও সামনে এলো সামগ্রিক গাফিলতির আরেকটি উদাহরণ।

এর আগে পুরান ঢাকার নিমতলী, চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফআর টাওয়ার, সাভারের তাজরিন ফ্যাশন, সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আগুন লাগার পর নড়েচড়ে বসে সরকার। গঠন হয় তদন্ত কমিটি।

প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু কমিটির প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। আশ্বাস দেয়া হয় দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার। কিন্তু দৃশ্যপটে পরিবর্তন দেখা যায় না। ক’দিন বাদে সবাই ভুলে যায়। পুরানো ফাইলগুলো চাপা পড়ে যায় নতুনত্বের ভিড়ে। ফলে এবারও দৃশ্যপটে নতুন কিছু আসবে, থামবে মৃত্যুর মিছিল–এমনটা আশা করা বোকামিই বটে।

বেইলি রোডের ঘটনায় সর্বশেষ ৪৬ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে, হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন আরও পাঁচজন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল জানিয়েছেন, যারা হাসপাতালে আছেন তারা শঙ্কামুক্ত নন। ফলে তাদের মধ্যে কজন বেঁচে ফিরবেন তা বলা যাচ্ছে না। আবার বেঁচে থাকলেও তারা আর কখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেবন কি না, এমন আশা কম। কারণ শরীরের একটা বিরাট অংশ দগ্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে।

প্রতিবারই আগুন বা বিস্ফোরণের পর পত্রিকা, টেলিভিশনে টকশোতে ব্যাপক আলোচনা হয়। সরকার একের পর এক তদন্ত কমিটি গঠন করে। বেইলি রোডের ঘটনায়ও সরকার রীতির ব্যত্যয় ঘটায়নি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। পুলিশ, র‌্যাবসহ সিটি করপোরেশন বলেছে, তারাও বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।

কিন্তু বাংলাদেশে অগ্নিদুর্ঘটনার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমেই শেষ হয়। যদি কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা বা বিচার করত, সরকার বা ফায়ার সার্ভিসের কথা আমলে নিত, তাহলে বেইলি রোডের যে ভবন আগুনে পুড়ল, সেই ভবন কর্তৃপক্ষকে এর আগেও তিনবার চিঠি দেয়ার পরও কীভাবে সেটি চলছিল?

গত বছরের সেপ্টেম্বরেও ভবনটির অষ্টম তলায় থাকা অ্যাম্ব্রয়সিয়া রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড মিউজিক ক্যাফেকে ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউস ইন্সপেক্টর অধীর চন্দ্র হাওলাদার ফায়ার সেফটি প্ল্যান না থাকায় চিঠি দেন। বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে তিন মাস সময় দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যে রেস্টুরেন্ট বা ভবন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়নি। হাত গুটিয়ে বসে ছিল সরকারি সংস্থাগুলো, যারা ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবন সিল মারতে পারে।

শুধু এই ভবনকেই ফায়ার সার্ভিস আগে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে? না, ২০২২ সালের ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। তখন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেছিলেন, ২০১৯ সালে বঙ্গবাজার মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে অন্তত ১০ বার ব্যবসায়ীদের চিঠি দেয়া হয়েছিল। নোটিশও দেয়া হয়েছিল। এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে মার্কেটের সামনে ব্যানার টানানো হয়। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।

বেইলি রোডে আগুনের ঘটনায় সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহজালাল উদ্দিন (৩৪) ও তার স্ত্রী-সন্তানও মারা গেছেন।

গত বছরের ১৫ এপ্রিল রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগে। এর আগেই মার্কেটটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মালিক সমিতিকে চিঠি দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু কেউ ব্যবস্থা নেয়নি। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ফায়ার সার্ভিস ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা মার্কেটের তালিকা প্রকাশ করে। যেখানে রাজধানীর ৫৮টি মার্কেট ও শপিং মল পরিদর্শন করে। এর মধ্যে ৯টিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ, ১৪টিকে মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৩৫টিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়।

এরপর আলোচনা হয় মালিকপক্ষের সঙ্গে। কিন্তু ঝুঁকিমুক্ত তো দূরের কথা, আগের থেকে যেন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে ওইসব মার্কেট। এখন প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, এতবার নোটিশ, সতর্ক করার পরও কেন মালিকরা সতর্ক হন না?

২০২২ সালের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ১৩ জনসহ মারা যান ৫১ জন। বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের আগে দুটি তদন্ত দল পরিদর্শন করেছিল। ওই সময়ের সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মোল্লা সিকান্দার আলী বলেছিলেন, কনটেইনারের ভেতর কী ধরনের দ্রব্য আছে, তা খুলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনুমতি তাদের ছিল না। তাদের শুধু জানানো হয়েছিল কনটেইনারের ভেতরে গার্মেন্টস পণ্য আছে। এমনকি আগুন লাগার পরও ডিপোর ভেতর কী কী রাসায়নিক দ্রব্য আছে, সেই তথ্য জানানো হয়নি। ফলে ফায়ার ফাইটাররা আগুন নেভাতে গিয়ে বিস্ফোরণে মারা যান।

বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিক চট্টগ্রামের বাঁশখালী এলাকার বাসিন্দা ও স্মার্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিএম কনটেইনার ডিপোর পরিচালক মুজিবুর রহমান।

ওই বিস্ফোরণের পর ছয়টি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। প্রতিটি কমিটিই তাদের প্রতিবেদনে অব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরে। কিন্তু সেই বিএম ডিপোর অন্যতম মালিক মুজিবুর রহমান এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৬ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতিও।

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা কেমিক্যালের কারণে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মৃত্যু হয় ৭১ জনের।

ওই ঘটনায় ওয়াহেদ ম্যানশনের পাশে থাকা রাজমহল হোটেলের মালিক মো. আজম বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন। বলেছিলেন, তারা সেখানে অবৈধভাবে পারফিউম প্রতিষ্ঠান ভাড়া দিয়েছিল। যার কারণে আগুন তার ভয়ংকর রূপ দেখায়।

নিয়মানুযায়ী এত মৃত্যুর দায়ে ভবন মালিকদের সাজা হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভবন মালিক হাসান ও সোহেল আগেভাগে জামিন নিয়ে উল্টো মামলার বাদী মো. আজমের ওপর চড়াও হন। যার পরিপ্রেক্ষিতে আজম তখন থানায় নিরাপত্তা চেয়ে সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। বর্তমানে সেই ওয়াহেদ ম্যানশনের গায়ে নতুন রঙের প্রলেপ পড়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার পরও দিব্যি চলছে।

চুড়িহাট্টার ভবনটি সংস্কার করে আবার চালু করা হয়। ৪ তলা ভবনটির নিচতলায় কয়েকটি দোকান, দ্বিতীয় তলায় ব্যাংক, চতুর্থ তলায় ফ্যামিলি বাসা আছে। কিন্তু একটি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, চুড়িহাট্টার সেই ওয়াহিদ ম্যানশনে ঝুলছে মেয়াদোত্তীর্ণ অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র। ছবি: সংগৃহীত

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বরে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরিন ফ্যাশন ফ্যাক্টরিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১২ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। সেই ভবনেও ফায়ার এক্সিট ছিল না। যে বাড়তি সিঁড়ি ছিল, সেটি ছিল ভবনের ভেতরেই নিচতলায়। আবার বের হওয়ার পথটাও ছিল তালাবদ্ধ। ফলে আগুন লাগার পর ফ্যাক্টরি থেকে শ্রমিকরা বের হতে পারেননি।

তাজরিনের শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনায় মালিক দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। তদন্ত শেষে পুলিশ চার্জশিট দিয়েছে। দেলোয়ার হোসেন গ্রেফতার হয়েছিলেন। পরে আবারও জামিনেও বেরিয়ে এসেছেন। ১১ বছর পার হলেও সেই মামলার বিচার এখনও শেষ হয়নি। দেলোয়ার হোসেন এখনও একাধিক ফ্যাক্টরি চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর মৎস্যজীবী লীগের সভাপতিও হয়েছিলেন।

তাজরিনের শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনায় মালিক দেলোয়ার হোসেনের বিচার শেষ হয়নি।

একই অবস্থা বনানীর বহুতল বাণ্যিজিক ভবন এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পরের ঘটনা। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুর ১টায় লাগা আগুনে ২৭ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক আহত হয়। অগ্নিকাণ্ডের জন্য ভবনের অনুমোদন, নকশার ত্রুটি ও অগ্নিনিরাপত্তাকে দায়ী করা হয়। কিন্তু এরপর একে একে তদন্ত প্রতিবেদন থেকে বাদ পড়তে থাকে অপরাধীদের নাম।

২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যায় মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকার ‘রাখি নীড়’ নামে একটি ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণ হয়। ওই ঘটনায় ১২ জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু ঘটনার প্রায় তিন বছর হয়ে এলেও মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে বলে শোনা যায়নি। বিস্ফোরণের ঘটনায় করা মামলার তদন্তভার পাওয়া পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেণ, ছয়টি সরকারি সংস্থা তদন্ত করেছে। এর মধ্যে চারটি সংস্থা সিটিটিসিকে সহযোগিতা করছে না।

আর ঘটনার পরপরই ভবনটির ভেতরে ত্রুটিপূর্ণ লাইন থেকে নির্গত গ্যাস থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটেছে বলে ওইসময় বিস্ফোরক পরিদফতরের তদন্তে উঠে এসেছিল।

সেই ২০১২ সালের তাজরিনের ঘটনায় দেলোয়ার হোসেনের বিচার যদি সময়মতো শেষ হতো, তাহলে সম্ভবত নিমতলী, চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার, সীতাকুণ্ডের বিমএ ডিপো, মগবাজারের রাখি নীড় কিংবা বেইলি রোডে প্রায় অর্ধশত মানুষের মৃত্যু দেখত না দেশবাসী। সব ভবন মালিক থেকে শুরু করে যারা ভাড়া নিচ্ছেন সবাই অন্তত সাজা হওয়ার ভয়ে হলেও সতর্ক থাকতেন।

নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান মনে করেন, দুর্ঘটনা যে কোনো জায়গায় ঘটতে পারে, আগুন লাগতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের মতো এভাবে মানুষ বিশ্বের অন্য কোথাও মারা যায় না। কারণ এখানে দুর্ঘটনা ঘটে না, এখানে জেনেশুনে মৃত্যুকূপ তৈরি করে রাখা হয়। কিছুদিন পরপর তা বিস্ফোরণ ঘটায়।

তিনি বলেন, গাফিলতি যতদিন পর্যন্ত না শোধরাবে, অপরাধীরা শাস্তি পাবে; ততদিন এ শহর নিরাপদ হবে না।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন