আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
গত মাসের শেষ দিক থেকে ভারতে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এরইমধ্যে পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে। ভারতের পাশাপাশি অন্য কিছু দেশেও করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। খবর পিটিআই’র।
চলতি বছর করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির খবর পাওয়া বেশ কয়েকটি দেশের মধ্যে ভারতই সর্বশেষ। ভাইরাসটিকে বিশ্বব্যাপী মহামারি ঘোষণা করার পাঁচ বছরের বেশি সময় পরও এর নতুন নতুন ভেরিয়েন্টের আবির্ভাব অব্যাহত রয়েছে।
ভারতে এক সপ্তাহে করোনা রোগী বেড়েছে ১২০০ শতাংশের বেশি। ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশটিতে সক্রিয় করোনা রোগী ১ হাজার ২শ’ শতাংশের চেয়ে বেশি বেড়েছে।
রোববার সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩১ মে পর্যন্ত ভারতে সক্রিয় কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়িয়েছে।
ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, শনিবার সকাল পর্যন্ত দেশটিতে ৩ হাজার ৩৯৫ সক্রিয় করোনাভাইরাস রোগী ছিলেন। যা গত সপ্তাহের তুলনায় প্রায় ১ হাজার ২শ’ শতাংশ বেশি। গত ২২ মে ভারতে সক্রিয় করোনা রোগী ছিল ২৫৭। আর ২৬ মে ছিল ১ হাজার ১০ জন।
মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, শুক্রবার থেকে শনিবারের মধ্যে দেশটিতে ৬৮৫ জন নতুন করোনাভাইরাস আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে, যার মধ্যে অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
এনডিটিভি বলেছে, সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত রাজ্যগুলো হচ্ছে কেরালা, মহারাষ্ট্র ও দিল্লি। কেরালায় শুক্রবার ১৮৯ জন নতুন কোভিড আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। এই রাজ্যে সক্রিয় কোভিড রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৩৩৬ জন।
এ ছাড়া মহারাষ্ট্র ৪৬৭, দিল্লিতে ৩৭৫, গুজরাটে ২৬৫, কর্ণাটকে ২৩৪, পশ্চিমবঙ্গে ২০৫, তামিলনাড়ুতে ১৮৫ এবং উত্তরপ্রদেশে ১১৭ জন সক্রিয় রোগী রয়েছেন। অন্যদিকে রাজস্থানে ৬০, পুদুচেরিতে ৪১, হরিয়ানায় ২৬, অন্ধ্রপ্রদেশে ১৭ এবং মধ্যপ্রদেশে ১৬ সক্রিয় রোগীর তথ্য জানা গেছে। চলতি বছরে ভারতে কোভিডে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর) জানিয়েছে, পশ্চিম এবং দক্ষিণে করোনার রোগীদের নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে দেখা গেছে। নতুন রূপগুলো ওমিক্রনের সাবভেরিয়েন্ট।
আইসিএমআর প্রধান ড. রাজীব বেহেল বলেছেন, এই সাবভেরিয়েন্টগুলোই সংক্রমণ বৃদ্ধির মূল কারণ। তিনি জানান, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রথমে দক্ষিণ ভারতে, পরের পশ্চিম ভারত এবং এখন উত্তর ভারতেও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সব আক্রান্ত সমন্বিত রোগ নজরদারি কর্মসূচির (আইডিএসপি) মাধ্যমে নজর রাখা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, এখন পর্যন্ত সংক্রমণের তীব্রতা খুবই কম, তাই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তার মতে, এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ রোগী হালকা উপসর্গ নিয়ে সংক্রমিত হচ্ছেন। আর তাই জটিল রোগীর সংখ্যা খুবই কম। তবে তিনি বলেছেন, সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রস্তুত থাকাই সবচেয়ে ভালো।
২০২০ সালে শুরু হওয়া এই মহামারিতে এখন পর্যন্ত ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ৪ কোটি। মৃত্যু হয়েছে প্রায় সাড় ৫ লাখ মানুষের। বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিনেশন প্রকল্প-এর আওতায় ভারতের ৭২ কোটি মানুষকে টিকা দেয়া সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করেছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এদিকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের হার আবারও ঊর্ধ্বমুখী। এই পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় মাস্ক ব্যবহারে সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। বিশেষ করে বয়স্ক এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের ভিড়যুক্ত স্থান এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশটিতে ৫ হাজার ৩৬৪ জন সক্রিয় রোগী রয়েছেন।
এ ছাড়া ১ জানুয়ারি থেকে ভারতে ৪ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি কোভিড থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং ৫৫ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রধান রূপটি যা এই রোগের নতুন বিস্তার ঘটাচ্ছে সেটি এনবি.১.৮.১ নামে পরিচিত। এর কারণে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, চীন এবং হংকংসহ অন্যান্য দেশে আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে।
বিশেষ করে এই এনবি.১.৮.১ এখন চীন এবং হংকংয়ে উদ্বেগের মূল কারণ। তবে ভারতে কিছু ক্ষেত্রে এলএফ.৭ নামে দ্বিতীয় আরেকটি ভেরিয়েন্টও দায়ী। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে এনবি.১.৮.১ ভ্যারিয়েন্টের ১৩টি কেস রেকর্ড করার কথা জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংস্থা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, এপ্রিলের শেষ দিকে বিশ্বব্যাপী জমা দেয়া সিকোয়েন্সের প্রায় ১০.৭ শতাংশ ছিল এনবি.১.৮.১। যদিও, তার এক মাস আগে এটি ছিল মাত্র ২.৫ শতাংশ।
করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট এনবি.১.৮.১ প্রথম শনাক্ত হয় এই বছরের জানুয়ারিতে।
এটি একটি ‘রিকম্বিন্যান্ট’ ভেরিয়েন্ট, যার অর্থ এটি দুটি বা ততোধিক বিদ্যমান ভেরিয়েন্টের জেনেটিক মিশ্রণ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ২০২৫ সালের ২৩ মে এনবি.১.৮.১ ভেরিয়েন্টকে ‘পর্যবেক্ষণাধীন ধরণ (ভিইউএম)’ ঘোষণা করে ডব্লিউএইচও।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৩ সালের সংজ্ঞা অনুসারে, ভিইউএম হলো এমন একটি ভেরিয়েন্ট যার জিনগত পরিবর্তন হয়েছে, যা করোনাভাইরাসের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। প্রাথমিক তথ্য থেকে জানা যায়, এই ভেরিয়েন্টটি অন্যদের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে বা আরও সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে এটি এখনো নিশ্চিত করা হয়নি।
এছাড়া স্বাস্থ্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা সংক্রমণের ওপর করোনার এই ভেরিয়েন্টের প্রভাবের প্রমাণ এখনও স্পষ্ট নয়।
লারা হেরেরো নামে একজন ভাইরোলজিস্ট গত ২৮ মে দ্য কনভারসেশনে লেখেন, এখনো গবেষণার অধীনে থাকলেও এ পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রমাণ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, এনবি.১.৮.১ ভেরিয়েন্টটি সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
হেরেরো লিখেছেন, ‘ল্যাব-ভিত্তিক মডেল ব্যবহার করে গবেষকরা দেখেছেন যে পরীক্ষিত বেশ কয়েকটি ভেরিয়েন্টের মধ্যে, নতুন ভেরিয়েন্টটির মানব কোষের রিসেপ্টরগুলোর সাথে আবদ্ধ হওয়ার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। এর থেকে বোঝা যায় এটি পূর্ববর্তী ভেরিয়েন্টগুলোর তুলনায় কোষগুলোকে আরো দক্ষতার সাথে সংক্রমিত করতে পারে।’
রেনো স্কুল অব মেডিসিনের নেভাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি এবং ইমিউনোলজির অধ্যাপক সুভাষ ভার্মা ‘সিবিএস নিউজ’কে বলেছেন, ‘এটি আরো বেশি সংক্রমণযোগ্য’।
এনবি.১.৮.১ ভেরিয়েন্টের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে গলা ব্যথা, কাশি, পেশী ব্যথা, জ্বর এবং নাক বন্ধ থাকা। এটি বমি বমি ভাব এবং ডায়রিয়ার মতো গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল লক্ষণগুলোর কারণও হতে পারে।
চিকিৎসকরা বলেছেন, কোভিড সংক্রমণ, এই সংক্রান্ত গুরুতর অসুস্থতা এবং আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঠেকাতে টিকা একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
তবে ভাইরোলজিস্ট হেরেরো’র মতে, সহজে ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি এনবি.১.৮.১ টিকা বা পূর্ববর্তী সংক্রমণ থেকে অর্জিত রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা ‘আংশিকভাবে এড়িয়ে যেতে পারে’।
স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, বর্তমান কোভিড টিকাগুলো করোনার এই ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে ‘আপাতত’ কার্যকর হবে এবং মানুষকে গুরুতর অসুস্থতা থেকে রক্ষা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের নতুন ভেরিয়েন্টটি আগের যেকোনো ভেরিয়েন্টের চেয়ে বেশি মারাত্মক বা প্রাণঘাতী- এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে, এটি আরও সহজে ছড়িয়ে পড়ে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।