যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো ভারতের সামনে এনেছিল তার ভাণ্ডারে থাকা সবচেয়ে মূল্যবান ও সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান এফ-৩৫। পাশপাশি যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সামনে এফ-১৬, সুপার হর্নেট এবং বি-১বি সিরিজের বিমানও হাজির করেছে। এসবের মূল কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র চায় ভারত অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে রাশিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিক।
ভারত নানা কারণেই চায় তার সোভিয়েত আমলের যুদ্ধবিমান নিয়ে গড়া বিমানবাহিনীর আধুনিকায়ন করতে। তবে তা করতে গিয়ে দেশটি বেশ বাধার সম্মুখীন হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভারতকে যথাসময়ে যুদ্ধবিমান ডেলিভারি দিতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র। বিপরীতে পশ্চিমা মিত্ররাও ভারতকে ক্রমাগত রাশিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবর, মার্কিন প্রতিনিধি দল শুক্রবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) শেষ হওয়া অ্যারো ইন্ডিয়া শোতে অংশ নিয়েছিল। এই আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র বিগত ২৭ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করেছে। আয়োজনে মার্কিনিদের অংশগ্রহণ ইঙ্গিত দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের কৌশলগত মিত্রতা ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাঁকজমকপূর্ণ উপস্থিতির বিপরীতে ভারতের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ রাশিয়ার উপস্থিতি ছিল নিষ্প্রভ। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত অস্ত্র রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান রসোবোরনএক্সপোর্ট দেশটির বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড এয়ারক্রাফট এবং আলমাজ-আনতেই এর সঙ্গে যৌথ স্টল দিয়েছিল। যেখানে মূলত যুদ্ধবিমান, ট্রাক, রাডার এবং ট্যাংকের মিনিয়েচার মডেল প্রদর্শিত হয়েছে।
এর আগের মেলায় রসোবোরনএক্সপোর্ট ছিল অ্যারো ইন্ডিয়া শোর কেন্দ্রস্থলে। অবশ্য ভারত বিগত কয়েক দশকে যুদ্ধবিমান কেনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে প্রাধান্য দেয়ায় রাশিয়া এমন প্রদর্শনীতে তাদের যুদ্ধবিমানগুলো আনা বাদ দিয়েছে।
ভারতের দ্বিতীয় বিমানবাহী রণতরীর জন্য যুদ্ধবিমান সরবরাহ করতে এরই মধ্যে প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করেছে বোয়িং এবং লকহীড মার্টিনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। বোয়িং ভারতীয় নৌবাহিনীকে এফ/এ-১৮ সুপার হর্নেট দেয়ার পথে এগিয়ে গেছে। লকহীড মার্টিনও এগিয়ে এসেছে এফ-২১ নিয়ে। নৌবাহিনীর পর এবার তারা ভারতীয় বিমানবাহিনীকেও একই মডেলের বিমান দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
চীন ও পাকিস্তানকে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে ২০ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ১১৪টি মাল্টিরোল ফাইটার জেট কেনার বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকে ঝুলে আছে। তবে ভারতের বিমানবাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে, ভারত এখন পর্যন্ত এফ-৩৫ কে নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করছে না। তবে অ্যারো ইন্ডিয়াতে প্রথমবারের মতো দুটি এফ-৩৫ এর প্রদর্শন ওয়াশিংটনের কাছে নয়াদিল্লির ক্রমবর্ধমান কৌশলগত গুরুত্বই তুলে ধরে।
এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অঙ্গদ সিং বলেছেন, ‘ওয়াশিংটনের এফ-৩৫ প্রদর্শন ভারতের কাছে বিক্রির টোপ দেয়ার জন্য ছিল না বরং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সম্পর্কের জন্য এট গুরুত্বপূর্ণ একটি সংকেত।’ তিনি আরও বলেন, ‘অস্ত্র বিক্রি সম্পর্কের মূল ভিত্তি না হলেও ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক স্তরে এখন একটি উষ্ণ সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্র কোন কোন দেশকে এফ-৩৫ দেবে সে বিষয়ে তারা খুবই সতর্ক। তবে এই সর্বাধুনিক প্রযুক্তির যুদ্ধবিমনাটি ভারতকে দেয়া হবে কি না জানতে চাইলে ভারতে মার্কিন দূতাবাসের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে রিয়ার অ্যাডমিরাল মাইকেল এল. বেকার বলেন, ‘নয়াদিল্লি বিমানটি চায় কি না তা বিবেচনা করার বিষয়টি তো খুব প্রাথমিক শর্ত।’ তবে এই বিষয়ে ভারতের বিমানবাহিনী এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খোলেনি।
অ্যারো ইন্ডিয়া প্রদর্শনীর আগে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থাগুলো জানিয়েছে, বিগত পাঁচ বছরে মস্কো নয়াদিল্লিকে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং দিল্লি আরও ১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রের অর্ডার দিয়েছে।
বিপরীতে, যুক্তরাষ্ট্র গত ছয় বছরে ভারতের কাছে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে পরিবহন বিমান, অ্যাপাচি, চিনুক এবং এমএইচ-৬০ হেলিকপ্টার, ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, নেভাল গান এবং পি-৮আই পসাইডোন নজরদারি বিমান।
ভারতও বৈশ্বিক জায়ান্টদের সহযোগিতায় নিজ আঙিনায় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি করতে চায়। তাদের লক্ষ্য হলো প্রথমে নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে বাইরেও রফতানি করা। আর এ কাজে যে ভারতকে সাহায্য করবে দেশটি তার দিকেই ঝুঁকে যেতে পারে। তাই বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানকে সামনে রেখে ভারতকে আস্থায় নিয়ে রাশিয়া থেকে নয়াদিল্লির মুখ ফেরাতে চায়।
রয়টার্স থেকে অনূদিত