আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টির নতুন নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে ভোটাভুটি চলছে। ভোটাভুটিতে সাবেক নেতা ও প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের উত্তরাধিকারী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন তিনি। যদিও বিজয়ী হতে তাকে এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে। তবে তার প্রধানমন্ত্রী হওয়া অনেকটা নিশ্চিত বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
২০১৯ সালে জাতীয় নির্বাচন বড় ব্যবধানে জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসলেও একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন বরিস জনসন। অবশেষে চলতি মাসের শুরুর দিকে (৭ জুলাই) ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে রীতিমতো বাধ্য হন তিনি।
এরপরই দলের সম্ভাব্য প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর তালিকায় উঠে আসে ঋষি সুনাকের নাম। গত সপ্তাহে পদত্যাগের আগ পর্যন্ত তিনি বরিস মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থ মন্ত্রণালয় সামলে আসছিলেন।
কনজারভেটিভ দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয় গত বুধবার (১৩ জুলাই)। এরপর বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) পর্যন্ত দুই রাউন্ড ভোটাভুটি হয়েছে এবং উভয় রাউন্ডেই সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন সুনাক। প্রথম রাউন্ডে ৮৮টি ভোট পেলেও দ্বিতীয়বার আরও বেশি অর্থাৎ ১০১ ভোট পান। ভোটের হিসেবে ৮৩টি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পেনি মরডন্ট।
গোপন ব্যালটের ভোটাভুটিতে এগিয়ে থাকলেও বরিস জনসন ও তার মিত্র আইনপ্রণেতাদের প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়েছেন সুনাক। সুনাকের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ করছেন বরিস ঘনিষ্ঠরা। তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী বরিসের পতনে প্রকাশ্যে সহযোগিতা করেছেন সুনাক। কারণ অর্থমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া সত্ত্বেও মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি।
তবে বরিসদের এ অভিযোগ একেবারেই গায়ে মাখছেন না সুনাক। কারণ নিজেকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই বরিসের মন্ত্রিসভার বেশিরভাগ হেভিওয়েট মন্ত্রীর সমর্থন বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি।
সুনাক অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এর কয়েক সপ্তাহ পরই শুরু হয় করোনা মহামারির তাণ্ডব। একের পর এক করোনা বিধিনিষেধ আর লকডাউনে অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে।
কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ঠিক রাখতে বিশ্বের বেশিরভাগ সরকার ও রাজনীতিক যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন, তখন শক্ত হাতেই নিজ দেশের পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন সুনাক। এর ফলে তার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। দুই বছর পর যার ফসল ঘরে তুলছেন তিনি।
এই মুহূর্তে সুনাককেই প্রধানমন্ত্রিত্বের মূল দাবিদার বা ‘ক্লিয়ার ফ্রন্টরানার’ হিসেবে চিহ্নিত করছে ব্রিটিশ গণমাধ্যমেও। দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ব্রিটিশ রাজনীতির ইতিহাসে ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্ব বাছাইয়ে এটাই প্রথম কোনো ভোটাভুটি যেখানে প্রার্থীদের মধ্যে নানা জাতি গোষ্ঠির সমাবেশ ঘটেছে।
৮ জন প্রার্থীর দুইজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত, একজন ইরাকি বংশোদ্ভূত আর একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। এর মধ্যে সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে রয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক।
সবকিছু ঠিক থাকলে প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনীতিক হিসেবে খুব শিগগিরই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসতে যাচ্ছেন সুনাক। শুধু তাই নয়, হবেন কনজারভেটিভ পার্টির নেতাও।
এদিকে সুনাককে ঘিরে ভারতে ইতোমধ্যে তুমুল উদ্দীপনা আর মাতামাতি শুরু হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে রীতিমতো আলোচনার ঝড় বইছে।
গুগলে-টুইটারে তাকে সার্চ করছেন কোটি কোটি ভারতীয়। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারও অধীর আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য রাখছে, সুনাক শেষ পর্যন্ত সত্যিই ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে পৌঁছতে পারেন কিনা।
ভারতের খ্যাতনামা শিল্পপতি আনন্দ মাহিন্দ্রা একটি ছবি টুইট করেছেন যা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ছবিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটকে দেখা যাচ্ছে যা হিন্দু রীতিতে ফুল, বেলপাতা আর পবিত্র স্বস্তিকা চিহ্ন দিয়ে সাজানো হয়েছে। ঠাট্টাচ্ছিলে তিনি লিখেছেন– ‘এই কি ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের ভবিষ্যৎ?’ তার ওই টুইটার বার্তায় হাজার হাজার কমেন্টের স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
টুইটে ঋষি সুনাকের নাম না-নিলেও আনন্দ মাহিন্দ্রা কী বোঝাতে চেয়েছেন তা ছিল স্পষ্ট। বস্তুত ব্রিটিশ কেবিনেটের সদস্য হিসেবে ঋষি সুনাক শপথও নিয়েছিলেন হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ভাগবত গীতায় হাত রেখে। তিনি যে ধর্মবিশ্বাসে একজন হিন্দু, সে কথা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেন।
একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন এবং তিনি গীতা স্পর্শ করে শপথ নিয়েছিলেন- মূলত এই বার্তাই ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনার প্রধান বিষয়।
সুনাকের বাবা-মা মূলত পূর্ব-আফ্রিকার দেশ কেনিয়া থেকে যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন। তবে তারা উভয়ে জন্মগতভাবে ভারতীয় ছিলেন। সুনাকের বাবা যশবীর ও মা ঊষা- দুজনেরই জন্ম ভারতের পাঞ্জাবে।
বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রধানত উন্নত জীবন ও কাজের খোঁজে প্রথমে আফ্রিকা এরপর যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান তারা। যশবীর একজন ডাক্তার হিসেবে ও ঊষা ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করতেন।
যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটনে দুই ভাগ্যান্বেষীর ঘরে ১৯৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন ঋষি সুনাক। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী সুনাকের আনুষ্ঠানিক পড়াশুনার শুরু হয় বেসরকারি উইনচেস্টার কলেজিয়েট স্কুলে যোগদানের মধ্যদিয়ে।
পড়াশুনা চালিয়ে নিতে সেই বয়সেই কঠোর পরিশ্রম করেছেন সুনাক। ছুটির দিনগুলোতে সাউদাম্পটনের একটি রেস্তোরাঁয় ওয়েটার হিসেবে কাজ করতেন তিনি।
সফলতার সঙ্গে স্কুল শেষ করার পর ২০০১ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন সুনাক। সেখানে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর ডিগ্রি নেন। এরপর আরও উচ্চতর পড়াশুনার জন্য পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে।
২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যানফোর্ডে এমবিএ ডিগ্রি লাভ করেন। সুনাকের আর একটা পরিচয় হলো তিনি ভারতের বিখ্যাত শিল্পপতি ও বহুজাতিক কোম্পানি ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা এন আর নারায়ণমূর্তির জামাতা।
নারায়ণমূর্তির কন্যা অক্ষতার সঙ্গে তার আলাপ স্ট্যানফোর্ডে এমবিএ পড়াকালেই। পরে তাকে বিয়েও করেন এবং তাদের দুই কন্যা সন্তানও রয়েছে।
পড়াশুনার চলমান অবস্থাতেই চাকরি শুরু করেন সুনাক। ২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাক্স-র বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি পরবর্তীতে দুই দুটি হেজ ফান্ডের অংশীদার হন এবং নিজেকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
মূলত ব্যবসায় থেকে সরাসরি রাজনীতিতে নাম লেখান সুনাক। বর্তমানে মাত্র ৪২ বছর বয়সী সুনাককে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে ধনী এমপি বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু তার সম্পদের পরিমাণ ঠিক কত সে ব্যাপারে প্রকাশ্যে কখনও কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
এছাড়া তার স্ত্রী অক্ষতা মূর্তিও বহু সম্পদের মালিক। এমনকি তাকে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের চেয়েও ধনী মনে করা হয়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম সানডে টাইমসের ২০২১ সালের ধনী ব্যক্তিদের তালিকাতেও অক্ষতার নাম ছিল। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্যমতে, বর্তমানে ৭৩০ মিলিয়ন পাউন্ডের সম্পত্তি রয়েছে সুনাক পরিবারের।
লন্ডন ও কেনসিংটনে এই দম্পতির যে পেন্ট হাউস রয়েছে, তার প্রতিটির মূল্য আনুমানিক ৭০ লাখ পাউন্ড। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ও সান্টা মোনিকায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। স্ত্রী অক্ষতার বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিসে কয়েকশ বিলিয়ন ডলারের শেয়ার রয়েছে বলে দাবি সংবাদমাধ্যমের।
ব্যবসায়ের মতো রাজনীতিতেও সুনাকের উত্থান বিস্ময়করই বটে। ২০১৪ সালে ইয়র্কশায়ারের রিচমন্ড আসনে প্রথমবার কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী হন। এরপর ২০১৫ সালে সাধারণ নির্বাচনে ওই আসন থেকে ব্যাপক ব্যবধানে এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালে ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ) ইস্যুতে বিচ্ছেদের পক্ষে অবস্থান নেন সুনাক।
এতে রাতারাতি তার ভাগ্য খুলে যায়। ব্রেক্সিট গণভোটে হেরে বিদায় নিতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। এরপর ২০১৭ সালের আগাম নির্বাচনে একই আসন থেকে ফের এমপি নির্বাচিত হন সুনাক।
প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে’ সরকারের মন্ত্রিসভার স্থানীয় সরকার বিষয়ক উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। এরপর বরিস জনসনের আমলে প্রথমে রাজস্ব বিষয়ক মন্ত্রী এরপর ২০২০ সালে অর্থমন্ত্রী হন।
