হোম অন্যান্যশিক্ষা ‘ব্যর্থতা ঢাকতে’ পরীক্ষাবিধি লঙ্ঘনে মেতেছেন জাবি শিক্ষকরা

শিক্ষা ডেস্ক:

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে পরীক্ষাবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক। আগের শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষার ফল প্রকাশ না করে পরের শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা এবং একসাথে একাধিক শিক্ষাবর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে। যদিও এমন রীতি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। তবুও নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা না নেয়া ও ফল প্রকাশ করতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতেই একাধিক বিভাগের শিক্ষকরা নিয়মের সব বিধি উপেক্ষা করেই ‘সেশনজট কমাতে’ এমন ধারা শুরু করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের সূত্রমতে, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা, আইন ও বিচার, বাংলা এবং ফার্মেসি বিভাগে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।

শিক্ষার্থীদের দাবি, শিক্ষকরা পাঠদানের বদলে ব্যক্তিগত কাজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে সময় বেশি দেয়ায় নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি। এতে পরীক্ষা ও ফলপ্রকাশ নিয়ে অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা।

অন্যদিকে শিক্ষকদের দাবি, সেশনজটে আটকে থাকা শিক্ষার্থীদের ‘কল্যাণের কথা চিন্তা’ করে দ্রুত শিক্ষাজীবন শেষ করতে তারা এই পথ বেছে নিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের আন্তরিকতার শেষ নেই। কিন্তু সঠিক সময়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা না নিয়ে নিয়ম লঙ্ঘন কেন, এমন প্রশ্নে মেলেনি সন্তোষজনক কোনো জবাব। জানিয়েছেন, প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই এমনটা করা হচ্ছে, আছে শিক্ষার্থীদের সায়।

কিন্তু কোন সময়ে গিয়ে সায় দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা? একই শিক্ষাবর্ষে যখন দেড় থেকে দুই বছর পড়ে আছেন, তখন তারাও চাইছেন যেকোনো উপায়ে পরীক্ষা হোক। ঠিক সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিভাগের শিক্ষকরা তাদের কাছ থেকে গণস্বাক্ষর নিয়ে তা প্রশাসনের কাছে জমা দিচ্ছেন। দেখাচ্ছেন, একাধিক ব্যাচ একই শিক্ষাবর্ষে আছে, কিন্তু তাদের পরীক্ষা হয়নি। আবার পরীক্ষা শেষ হলেও ফলাফল প্রকাশ হয়নি। এরই মধ্যে পরের শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষার সময়ও পার হয়ে যাচ্ছে। এখন পরীক্ষাবিধি মানতে গেলে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে, এতে বিভাগটিতে আরও সেশনজট তৈরি হবে। তাই ‘শিক্ষার্থীদের কল্যাণে’ তাদের পরীক্ষার বিশেষ অনুমতি দিতে হবে।

তখন ‘শিক্ষার্থীদের বলির পাঁঠা’ বানানোর এই কৌশলের কাছে হার মেনে বিধি লঙ্ঘন করে পরীক্ষা আয়োজনের এই অনুমতি দিয়ে দিচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। যদিও সঠিক সময়ে ক্লাস-পরীক্ষা শিক্ষকরা শেষ করছেন কি না, তার খোঁজখবর রাখা প্রশাসনে থাকা কর্তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু তারা কোনো দায়িত্বই পালন করছেন না।

বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি
বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট যাত্রা শুরু করে ২০১৭-১৮ (৪৭ ব্যাচ) শিক্ষাবর্ষ থেকে। ওই ইনস্টিটিউটে বর্তমানে শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র তিনজন। আর অভিযোগ আছে পরিচালক অধ্যাপক শামীম রেজাও দুপুরের দিকে বিভাগ ছাড়েন। তিনি বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব লিবালের আর্টস (ইউল্যাব) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

জাবির নিজ ইনিস্টিউটে পাঠদানে মনযোগ কম, বর্তমানে বেসরকারি ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক শামীম রেজা। ইউল্যাবের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া স্ক্রীনশট

একদিকে শিক্ষক সংকট, অন্যদিকে তদারকির অভাবে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে নতুন চালু হওয়া এই ইনস্টিটিউটে।

আর সেই দায় থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে ৪৭ ব্যাচের স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের ফলাফল প্রকাশ না করে তাদের বসানো হয়েছে চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষায়। চলতি বছরের ২৩ জুলাই থেকে চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরু হয়েছে, যা এখনও চলছে। ফলে শিক্ষার্থীরা জানেনই না তারা তৃতীয় বর্ষে পাস করেছেন কি না। আর ফেল করলে কি হবে তা-ও জানা নেই তাদের। অথচ চলমান এই পরীক্ষা শেষ হলেই তারা উঠে যাবে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে। অথচ এখনও তৃতীয় বর্ষ পাস করেননি।

ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক শামীম রেজা বিধি লঙ্ঘনের পুরো দায় চাপালেন শিক্ষক সংকটের ওপর। বলেন, ‘আমার ইনস্টিটিউটে মাত্র তিনজন শিক্ষক। অধিকাংশ কোর্স পড়ানোর জন্য ঢাকা ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিতে হয়। তবে আমাদের সম্মানী কম (৬০০ টাকা প্রতি ক্লাস) ও ঢাকা থেকে দূরে হওয়ায় শিক্ষকরা আসতে চায় না।’

তিনি উদাহারণ দিয়ে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কোর্স শেষ করলে শিক্ষকরা ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা পান। আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৭৫ হাজার।’

আইন ও বিচার বিভাগ
আইন ও বিচার বিভাগে ২০১৬-১৭ (৪৬ ব্যাচ) এবং ২০১৭-১৮ (৪৭ ব্যাচ) শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ২৫ জুলাই থেকে একই রুটিনে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এর আগে ৪৬ ও ৪৭ ব্যাচের স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষায়ও একই সাথে নেন বিভাগের শিক্ষকরা। আর স্নাতক পরীক্ষায় ৪৬ ব্যাচে ৯ জন ও ৪৭ ব্যাচে ৮ জন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়।

এতে প্রচলিত নিয়মে মান উন্নয়ন পরীক্ষা দিয়ে নিয়মিত শিক্ষাবর্ষের সাথে পড়াশোনা চালানোর সুযোগ ছিল না। ফলে প্রতিটি কোর্সের জন্য ১৪ হাজার টাকা ফি দিয়ে বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে তারা স্নাতক শেষ করেন। কেননা, একই সাথে দুটি ব্যাচ স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত।

যদিও বিভাগীয় সভাপতি ও আইন ও বিচার অনুষদের ডিন তাপস কুমার দাস দাবি করেছেন, বিশেষ পরীক্ষা দিতে শিক্ষার্থীদের কোনো অর্থ দিতে হয়নি। উপাচার্য তাদের টাকা মওকুফ করেছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা নিশ্চিত করেছেন, তারা নিজ খরচে দিয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন।

আর দুটো ব্যাচের একসাথে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে শিক্ষক সংকটের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দিকেও দায় চাপালেন তাপস কুমার দাস। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষাবিধিতে এমনটা বলা নেই। কিন্তু আমাদের মাত্র ৯ জন শিক্ষক, ৬টি ব্যাচ চলমান। করোনার কারণে ৪৬ ব্যাচ অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এ জন্য একই সাথে পরীক্ষা নিতে হচ্ছে। আর শিক্ষার্থীরাও চাচ্ছিল দ্রুত পরীক্ষা শেষ করতে। এ জন্য তারা সবাই স্বাক্ষরও করেছে। তাদের সেই দাবি আমরা প্রশাসনকে জানিয়ে সেশনজট কমাতে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) থেকে অনুমতি নিয়েই পরীক্ষা নিচ্ছি।’

নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ
নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে ফলাফল প্রকাশের দীর্ঘ্যসূত্রতা দেখা গেছে। যার ফলে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের (৪৫ ব্যাচ) স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেই ২০১৬-১৭ (৪৬ ব্যাচ) শিক্ষাবর্ষের স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ করা হয়।

৪৫ ব্যাচে মাত্র ১২ জন শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তরে অংশগ্রহণ করেছে। তবে তাদের থিওরি পরীক্ষা ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শেষ হলেও ফল প্রকাশ হয়েছে ১০ মাস পরে ২০২৩ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে।

এ বিষয়ে বিভাগীয় সভাপতি অধ্যাপক ড. আনিশা নূরী কাঁকন বলেন, ‘আমার বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় শ্রেণিতে থিসিস থাকায় ফলাফল প্রকাশ করতে দেরি হয়েছে। কেননা, থিসিস মূল্যায়ন একটি সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া।’

একই ধরনের দীর্ঘসূত্রতা দেখা গেছে বাংলা বিভাগে। সেখানে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের (৪৬ ব্যাচ) ফল প্রকাশ না করেই ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের (৪৭ ব্যাচ) স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষায় শুরু করেছে। একইভাবে ফার্মেসি বিভাগ ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের (৪৬ ব্যাচ) তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ না করে চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা শেষ করেছে। শুধু তা-ই নয়, ফলাফল প্রকাশ করতে প্রায় দুই বছরের বেশি সময় নিয়েছেন বিভাগের শিক্ষকরা।

যা আছে পরীক্ষাবিধিতে

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সংক্রান্ত আইন, অর্ডিন্যান্স পারটেইনিং টু রুলস ফর কনডাক্টিং এক্সামিনেশনস এন্ড এক্সামিনেশন অফেন্স অ্যান্ড ডিসিপ্লিন ২০০৩-এর ২০ (iii) ধারায় বলা হয়েছে, প্রতি পাঁচটি খাতার জন্য একদিন হিসেবে মোট সময় (দিন) হিসেব করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে খাতা দেয়া হবে।

২৬ (iii) এ বলা হয়েছে, লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার ৭৫ দিনের মধ্যে অবশ্যই ফলাফল প্রকাশ করতে হবে। আর ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, থিওরি পরীক্ষা শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে অবশ্যই থিসিস জমা দিতে হবে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিভাগের ফলাফলের কী অবস্থা তা জানার জন্য এবং সেশনজট কাটানোর জন্য সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিনদের সাথে আলোচনা করেছি। আইন অনুষদে শিক্ষার্থীদের প্রতি মানবিক আচরণ করে পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছি। এ ছাড়া নতুন শুরু হওয়া বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্যে বিধি লঙ্ঘন করে পরীক্ষা নেয়া কাম্য নয়। কোনোভাবেই একসঙ্গে দুই শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা নেয়া যাবে না।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষকদের পাঁচটি খাতা মূল্যায়নের জন্য এক দিন করে সময় দেয়া হয়, যা ৭৫ দিনের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট।’ ফলে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে ছাত্র-শিক্ষকদের সহযোগিতা চাইলেন ড. মোস্তফা ফিরোজ।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন