আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
১৫ মে, ১৯৪৮ সাল। ফিলিস্তিনিদের জন্য দিনটি অবমাননা ও বিপর্যয়ের। তারা বলেন ‘নাকবা’। আরবি শব্দটির বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায় ‘বিপর্যয়, দুর্ঘটনা ও দুর্ভাগ্য’।
৭৪ বছর আগে এদিন ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। তাদের ভূখণ্ডে দখল করে অবৈধভাবে ইসরাইল নামের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের স্বাধীকার লড়াই চলছে।-খবর আলজাজিরা, তাসনিম ও মিডল ইস্ট আইয়ের।
নাকবা দিবস পালনে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে রোববার (১৫ মে) বিক্ষোভ হয়েছে। লন্ডনে ব্রিটিশ সম্প্রচার কর্পোরেশনের (বিবিসি) প্রধান কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে বিপুল মানুষ অংশ নেন। এরআগে তারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনেও বিক্ষোভ করেন।
আলজাজিরার খবর অনুসারে, সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে বসতবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ইসলাইল নামের একটি রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নাকবা। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে যেটিকে ইসরাইল-ফিলিস্তিনি সংঘাত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলেন, নাকবা দিয়ে মূলত ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের ওপর জাতিগত নিধন বোঝানো হয়। ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও তাড়িয়ে দিতে ৭০টির মতো গণহত্যা চালিয়েছে উগ্র ইহুদিবাদীরা।
১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ সাল—এ সময়টিতেই ইসরাইলের অস্তিত্ব শুরু হয়। তখন থেকে তারা ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে বাধ্যতামূলকভাবে ফিলিস্তিনকে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। তখন মধ্যপ্রাচ্যের সীমান্তকে নতুন করে পুনর্বিন্যাস করছিল জাতিসংঘ ও বিশ্বশক্তিগুলো।
কিন্তু এই পরিকল্পনায় সাধারণ মানুষের মতামতকে গ্রাহ্য করা হয়নি। ফিলিস্তিনের মধ্যেই একটি ইহুদি রাষ্ট্রের ভিত্তি ধরে ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। প্রস্তাবটি পাস হওয়ার আগে ইহুদিদের ভূমি ছিল মাত্র ছয় শতাংশ।
জনসংখ্যায় ফিলিস্তিনিরা ছিলেন ৬০ শতাংশ, ইহুদিরা ৩২ শতাংশ। বাকিরা আট শতাংশ। কিন্তু ভূখণ্ড ভাগ হওয়ার সময় ইহুদিদের দেওয়া হয় ৫৫ শতাংশ, ফিলিস্তিনিদের ৪৫ শতাংশ, আর তিন শতাংশ থাকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে।
নতুন ভূখণ্ডের দখলে নিতে পরিকল্পনা করে হাগানাহসহ বিভিন্ন ইহুদি আধাসামরিক গোষ্ঠী। তাদের নেতা ছিল আইজ্যাক রবিন, অ্যারিয়েল শ্যারন ও মোসি ডায়ান। ফিলিস্তিনি জনবহুল অঞ্চলগুলো খালি করে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরিকল্পনা করে তারা।
সিরিয়া ও লেবানন সীমান্তে ফিলিস্তিনের উত্তরাঞ্চল, উপকূলীয় অঞ্চলসহ জেরুজালেম ও জাফার মধ্যবর্তী বিভিন্ন শহর-নগর-গ্রামকে ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে ইহুদি আধাসামরিক বাহিনীগুলো। যেসব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে, সেগুলোতে অগ্নিসংযোগ, উড়িয়ে দেওয়া ও মাইন পেতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে দালেত পরিকল্পনা নেয় তারা।
তখন থেকে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা, বাড়িঘর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া ও কমিউনিটিকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংঘাতে ইহুদিরাও নিহত হয়েছে। তবে সেই সংখ্যা বেশি না।
নাকবায় ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত ও আট লাখ বাস্তুচ্যুত হন। ৪১৮টি গ্রাম ও শহরে জাতিগত নিধন চালানো হয়। আর দেড় লাখ ফিলিস্তিনি নিজ ভূখণ্ডের মধ্যেই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ৭৮ শতাংশ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইহুদিদের হাতে।
ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন থেকে যেসব বাসিন্দাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা আর কখনো নিজ ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে পারেননি। ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদের বংশধরেরা গাজা, পশ্চিমতীর ও বিভিন্ন দেশের শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছেন। ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার ৭৪ শতাংশ বর্তমানে শরণার্থীর জীবন যাপন করছেন।