হোম জাতীয় প্রশাসনে চলছে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা

প্রশাসনে চলছে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 13 ভিউজ

অনলাইন ডেস্ক:
প্রশাসনে এক ধরনের স্থবিরতা চলছে। সর্বত্র রয়েছে সমন্বয়ের অভাব। পদোন্নতি, ক্যাডার বৈষম্য, মহার্ঘ ভাতার দাবিসহ সচিবালয়ের কর্মচারীরা সোচ্চার নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে। এর মধ্যে চলছে বাধ্যতামূলক অবসর, ওএসডি করাসহ ফ্যাসিবাদের দোসর শনাক্ত কার্যক্রম। একশ্রেণির সুবিধাবাদী কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এসব নিয়ে প্রশাসনে সৃষ্টি হয়েছে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা। এই উত্তেজনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি। এর ফলে সরকারি কাজকর্মে স্থবিরতা নেমে এসেছে।

জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে ৮ আগস্ট রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের সমন্বয়হীনতার কারণে গত সাত মাসেও কাঙ্ক্ষিত গতি ফেরেনি প্রশাসনে। সমন্বয়হীনতার কারণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিয়োগ দেওয়ার পরপরই তা বাতিল করা হয়েছে। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ দফতর ও মাঠ প্রশাসনে ডিসি ও ইউএনও পদে নিয়োগের পরই তা বাতিল করতে হয়েছে। এ কারণে সরকারের শীর্ষ প্রশাসনিক দফতর বাংলাদেশ সচিবালয় ও জেলা-উপজেলা প্রশাসনে স্থবিরতা নেমে এসেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর মধ্যেই জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ প্রতিবেদন ঘিরে প্রশাসনে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিব পদোন্নতির সুপারিশ নিয়ে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের আপত্তি, প্রশাসন ক্যাডার বাদ দিয়ে বাকি ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের পক্ষ থেকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের অস্পষ্ট রিপোর্ট ও জনবিরোধী প্রস্তাবগুলো প্রত্যাখ্যান করাসহ ’ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার’- স্লোগানে ডিএস পুলে কোটা বাতিল এবং সব ক্যাডারের সমতার দাবি, ‘সংস্কার বা পুনর্গঠন প্রস্তাব’ না থাকায় বিসিএস (পরিবার পরিকল্পনা) সাধারণ ক্যাডার সংশ্লিষ্ট বিবৃতিসহ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পরিবার পরিকল্পনা) অ্যাসোসিয়েশনের ৫ দফা, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের ৩ দফা এবং প্রশাসনের প্রথম থেকে দশম গ্রেডের কর্মকর্তারা ২০ শতাংশ এবং ১১তম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের ৩০ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতার দাবিতে প্রশাসনে চলছে চরম অসন্তোষ।

জানা গেছে, বিসিএস (পরিসংখ্যান) ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন সম্প্রতি এক প্রতিবাদলিপিতে জানায়, কমিশনের প্রতিবেদনে বিদ্যমান সিভিল সার্ভিসগুলোকে পুনর্বিন্যাস করে বিভিন্ন সার্ভিস ও এর কাঠামো পুনর্গঠনের প্রস্তাব করা হলেও একমাত্র বিসিএস (পরিসংখ্যান) ক্যাডারকে পুনর্গঠিত সার্ভিসগুলোর প্রস্তাবে ‘প্রযোজ্য নয়’ উল্লেখ করা হয়েছে। দাখিল করা সংস্কার প্রস্তাবে ১৯৮০ সালে সৃজিত গুরুত্বপূর্ণ পেশাভিত্তিক এ ক্যাডার সার্ভিসকে ‘অস্তিত্বহীন’ করার মতো অদূরদর্শী সুপারিশ আমাদের অত্যন্ত বিস্মিত ও ব্যথিত করেছে। সব বৈষম্য নিরসন ও গতিশীল জনবান্ধব জনপ্রশাসন তৈরির লক্ষ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টা এবং ছাত্রজনতার বৈষম্যবিরোধী মূল চেতনার সঙ্গে এ সুপারিশ সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। মূলত সংস্কার কমিশনের সুপারিশের মাধ্যমে বিসিএসে নিযুক্ত মেধাবী পরিসংখ্যানবিদদের সমন্বয়ে গঠিত এ সার্ভিসকে অবমূল্যায়ন করে আরেকটি নতুন বৈষম্য চাপিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বিসিএস (তথ্য-সাধারণ) ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস ইনফরমেশন অ্যাসোসিয়েশন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ভিন্ন প্রকৃতির তিনটি গ্রুপ ‘সাধারণ’, ‘অনুষ্ঠান’ ও ‘বার্তা’-কে একীভূত করে বাংলাদেশ তথ্য সার্ভিস নামে যে সার্ভিস গঠনের কথা বলা হয়েছে, তাতে এ ক্যাডারের সদস্যদের উদ্বেগের কারণ রয়েছে। গ্রুপ তিনটির কর্মপ্রকৃতি এতটাই ভিন্ন যে এগুলোকে কোনও একক সার্ভিসে একীভূত করা হলে তা একটি অকার্যকর সার্ভিসে পরিণত হতে পারে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বিসিএস (তথ্য-সাধারণ) ক্যাডারের সঙ্গে বাংলাদেশ বেতারের কোনও অংশকে একীভূত করা সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর কাজের মান বৃদ্ধি, কর্মকর্তাদের কল্যাণ কিংবা জনস্বার্থ কোনোটির জন্যই যৌক্তিক বলে প্রতীয়মান হয় না। বিদ্যমান বাস্তবতায়, কেবল বিসিএস (তথ্য-সাধারণ) গ্রুপকে নিয়ে বাংলাদেশ তথ্য সার্ভিস করা যায়। পাশাপাশি প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য একটি স্বতন্ত্র ‘সম্প্রচার সার্ভিস’ গঠন করা যেতে পারে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত একীভূত তথ্য সার্ভিস বিষয়ে বিসিএস ইনফরমেশন অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতির তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিসিএস তথ্য সাধারণ বেতার কর্মকর্তারা।

এদিকে সরকারের পেনশনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ৩ দফা দাবি জানিয়েছে। সেই দাবিগুলো হলো- ১. বর্তমান চিকিৎসার ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বয়সভেদে চিকিৎসা ভাতা ১০ হাজার টাকা প্রয়োজন। পাশাপাশি চিকিৎসা ক্ষেত্রে সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে শিশু বিভাগের মতো প্রবীণদের আলাদা চিকিৎসা বিভাগ খোলা। ২. সমপদে একই কাজে পেনশনের বৈষম্য দূর করতে হবে। ৩. শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীদের ১৫ বছরের পরিবর্তে ১০ বছর পেনশন প্রতিস্থাপন করা।

যোগ্যতা অর্জনের পরও উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব এবং সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি না পাওয়ায় হতাশায় ভুগছেন প্রশাসনের অন্তত এক হাজার কর্মকর্তা। যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির জন্য নিয়মিত হিসেবে ২৪ ব্যাচকে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই ব্যাচ ২০০৫ সালের ২ জুলাই চাকরিতে যোগ দেয়। বিলুপ্ত ইকোনমিক ক্যাডারের ১৯ কর্মকর্তাসহ এ ব্যাচের পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেছেন ৩৩৭ জন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় লেফট-আউট হয়ে বঞ্চিত আছেন ৪৩ কর্মকর্তা। অন্যান্য ক্যাডারের যোগ্যতা অর্জন করেছেন ১৯৪ কর্মকর্তা। সব মিলিয়ে যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতির জন্য যোগ্যতা অর্জন করেছেন ৫৭৪ জন। সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি দিতে নিয়মিত ব্যাচ হিসেবে ৩০ ব্যাচকে বিবেচনা করা হচ্ছে। লেফট-আউটসহ প্রশাসন ক্যাডারের ৩১৯ জন কর্মকর্তা পদোন্নতির যোগ্য হয়েছেন। এ ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারের ২২৩ কর্মকর্তা ডিএস পুলে যোগ দিতে আবেদন করেছেন। এই মুহূর্তে দুই স্তরে পদোন্নতি প্রত্যাশী কর্মকর্তার সংখ্যা এক হাজারের বেশি।

এমন পরিস্থিতিতে সরকার ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি দিয়েছে ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বঞ্চিত দাবি করে আবেদন করা দেড় হাজার কর্মকর্তার (অবসরপ্রাপ্ত) মধ্যে ৭৬৪ জনকে উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব, গ্রেড-১ ও সচিব পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অপরদিকে, চলতি অর্থবছরে তাদের পাওনার অর্ধেক পরিশোধ করা হবে। তারা বাকি টাকা পাবেন আগামী বছর। এমনটি জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

অন্যদিকে, সচিব পদে ১১৯, গ্রেড-১ পদে ৪১, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮, যুগ্ম-সচিব পদে ৭২ ও উপ-সচিব পদে ৪ জনকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়।

এই পদোন্নতি নিয়েও চলছে অসন্তোষ। বিদ্যমান পদে থাকা কর্মকর্তারা বলছেন, আমরা দায়িত্ব পালন করছি, কিন্তু দীর্ঘদিন আমরা আমাদের অধিকারের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার হয়েছি। সেখানে আমাদের পদোন্নতিসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধাদি না দিয়ে ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি আরেক ধাপের বৈষম্যের জন্ম দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সচিবালয়সহ জেলা-উপজেলা প্রশাসনে চলছে অসন্তোষ।

বর্তমান সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রশাসনে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তে নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তা এখনও বহাল। শুরুতে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে নিয়োগ প্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। কর্মকর্তারা নজিরবিহীনভাবে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। পরে প্রতিবাদের মুখে ডিসি হিসেবে ৯ কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল করা হয়। এরপর বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের চেয়ারম্যান একেএম মতিউর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে নৌপরিবহন সচিব করার দুই দিন পর তা বাতিল করা হয়। এ ছাড়া ইলাহী দাদ খানকে খাদ্য সচিব নিয়োগের একদিন পরই বাতিল করা হয়। সর্বশেষ গত ১৩ জানুয়ারি বিতর্ক ওঠায় বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) ছয় সদস্যের নিয়োগ বাতিল করা হয়। এর আগে গত ২ জানুয়ারি তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কূটনীতিক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খাস্তগীরকে পোল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেওয়ার ১০ দিন পর বাতিল করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ধরনের আরও নজির রয়েছে।

তবে, অর্থনীতিবিদদের মতে, অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। রফতানি সাত মাসে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, রেমিট্যান্স ইতিহাসের রেকর্ড গড়েছে, ১৮ বিলিয়নে নামা রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ছুঁয়েছে। যদিও আকু পেমেন্ট করার কারণে এর পরিমাণ কিছুটা কমেছে। ব্যাংক খাতে লুটপাট বন্ধ হয়েছে, আস্থা ফিরেছে। অনেকটাই কমেছে মূল্যস্ফীতি, পাশে দাঁড়িয়েছে সহযোগী দেশগুলো। তবে এখনও অনেক কাজ করার বাকি রয়েছে, এই সরকারের প্রতি জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি মানুষকে নাজেহাল করে তুলছে। অর্থনৈতিক সংকট বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনকে পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। ফলে জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা এই উদ্বেগের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, আগে প্রশাসন ছিল যে রকমের এখন সে রকমই। তফাত শুধু মানুষের।

এ প্রসঙ্গে একজন সাবেক কেবিনেট সচিব জানিয়েছেন, প্রশাসনে কোনও ধরনের রাজনৈতিক ইন্ধন থাকা উচিত নয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনও ধরনের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নও সঠিক নয়। যদি তা করা হয় তাহলে তা হবে উপযুক্তদের জন্য অপমানের।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন