হোম অর্থ ও বাণিজ্য পাঁচ বছরে ২০ বিলিয়ন ডলারের তুলা কিনেছে বাংলাদেশ

পাঁচ বছরে ২০ বিলিয়ন ডলারের তুলা কিনেছে বাংলাদেশ

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 33 ভিউজ

নিউজ ডেস্ক:
তৈরি পোশাক রফতানিতে বিশ্বে শীর্ষস্থানে থাকা বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল হচ্ছে তুলা। দেশীয় উৎপাদন একেবারেই নগণ্য হওয়ায়, প্রায় শতভাগ তুলাই আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে। গত পাঁচ বছরে (২০২০-২০২৪) বাংলাদেশ ৩৬টি দেশ থেকে ৩৯ দশমিক ৬১ মিলিয়ন বেল তুলা আমদানি করেছে, যার ব্যয় প্রায় ২০ দশমিক ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে কৃষিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল ইকোনমিকস (বিএই) এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি বছরই তুলা আমদানি ও ব্যয়ের অঙ্ক উল্লেখযোগ্য, যদিও বছরভেদে কিছুটা ওঠানামা রয়েছে।

বছরভিত্তিক তুলা আমদানির চিত্র

২০২০ সালে ৬.৫২ মিলিয়ন বেল তুলা আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যয় হয়েছিল ৩.২৯ বিলিয়ন ডলার। পরের বছর ২০২১ সালে আমদানি বেড়ে দাঁড়ায় ১০.০৮ মিলিয়ন বেলে, ব্যয় হয় ৪.৭২ বিলিয়ন ডলার।

২০২২ সালে আমদানির পরিমাণ কিছুটা কমে ৮.৩৭ মিলিয়ন বেল হলেও মূল্য দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৫.০৪ বিলিয়ন ডলারে।

২০২৩ সালে তুলা আমদানি আরও কমে ৬.২৬ মিলিয়ন বেলে নেমে এলেও, ২০২৪ সালে তা আবার বেড়ে পৌঁছায় ৮.৩৮ মিলিয়ন বেলে। এই বছর তুলা আমদানিতে ব্যয় হয় ৩.৯২ বিলিয়ন ডলার।

তুলা আমদানির প্রধান উৎস

প্রধান উৎস আফ্রিকা

তুলা আমদানির ক্ষেত্রে আফ্রিকা এখন বাংলাদেশের প্রধান উৎস। এছাড়া বেনিন, মালি, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, ঘানা ও কেনিয়া থেকে মোট ১৬.৩২ মিলিয়ন বেল তুলা আমদানি করা হয়েছে, যার মূল্য ৮.১৬ বিলিয়ন ডলার— মোট আমদানির প্রায় ৪১ শতাংশ।

আফ্রিকার তুলা মানসম্মত, সহজলভ্য এবং তুলনামূলক কমদামে পাওয়া যায়— যার ফলে বাংলাদেশের স্পিনিং মিলগুলো এই উৎসের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল।

দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস ভারত

পাঁচ বছরে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ৯.৫২ মিলিয়ন বেল তুলা, যার বাজারমূল্য ৪.৮৩ বিলিয়ন ডলার। ভারতীয় তুলা বাংলাদেশের মোট তুলা আমদানির প্রায় ২৪ শতাংশ।

ভৌগোলিকভাবে কম দূরত্ব, স্থলবন্দরের সুবিধা (বেনাপোল, ভোমরা) ও দ্রুত সরবরাহ ভারতীয় তুলাকে বাংলাদেশের অন্যতম নির্ভরযোগ্য উৎসে পরিণত করেছে। এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “তৈরি পোশাক শিল্প একটি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার বাজার। এখানে অনেক সময় মাত্র এক-দুই সেন্টের পার্থক্যেই ক্রয়াদেশ হারাতে হয়। তাই কারখানাগুলোর টিকে থাকতে হলে সুতা প্রতিযোগিতামূলক দামে পাওয়া অত্যন্ত জরুরি। দেশি সুতা ব্যবহার অবশ্যই করবো, তবে তা যেন মানসম্পন্ন ও মূল্যসাশ্রয়ী হয়— সেটাই মূল কথা।”

তিনি আরও বলেন, “স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ হওয়ার পর দেশি মিলগুলোর অনেকে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন, অথচ বাজার নিয়ন্ত্রণে কোনও তদারকি নেই। ফলে পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা বাধ্য হয়ে বাড়তি দামে সুতা কিনছেন। এর ফলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হুমকির মুখে পড়ছে।”

যুক্তরাষ্ট্র: উচ্চমানের তুলার উৎস

যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঁচ বছরে ২.৮৪ মিলিয়ন বেল তুলা আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১.৮৭ বিলিয়ন ডলার— মোট আমদানির ৯ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের তুলার মান উচ্চতর এবং ফাইবার স্ট্যাপল দীর্ঘ হওয়ায় এটি মূলত বড় মিল ও স্পেশাল রফতানির কাজে ব্যবহৃত হয়।

অস্ট্রেলিয়া ও সিআইএস দেশগুলো

অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানিকৃত তুলার পরিমাণ ২.২৪ মিলিয়ন বেল, মূল্য ১.১৬ বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, রাশিয়া ও ইউক্রেনসহ সিআইএস দেশগুলো থেকে ০.৭৯ মিলিয়ন বেল তুলা আমদানি হয়েছে, যার মূল্য ৩৭৫ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।

অন্যান্য উৎস দেশ

ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চীন, কানাডা, গ্রিস, ইন্দোনেশিয়া, সুইজারল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে মোট ৭.৯ মিলিয়ন বেল তুলা আমদানি হয়েছে, যার মূল্য ৩.৮৭ বিলিয়ন ডলার—মোট আমদানির প্রায় ১৯ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কে ছাড়ের সম্ভাবনা

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তুলাভিত্তিক পোশাক রফতানিতে ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তবে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাহী আদেশ অনুযায়ী, কোনও পোশাক পণ্যে যদি অন্তত ২০ শতাংশ মার্কিন কাঁচামাল থাকে, তবে সেই অংশের ওপর পাল্টা শুল্ক প্রযোজ্য হবে না।

তিনি বলেন, “আমরা যদি ইউএস কটন বা কৃত্রিম তন্তু ব্যবহার করি, তাহলে ওই অংশে শুল্ক ছাড় পাওয়া যেতে পারে।”

বর্তমানে বাংলাদেশ প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৪০০-৫০০ মিলিয়ন ডলারের সুতা আমদানি করে। বিজিএমইএ মনে করে, এই আমদানির পরিমাণ বাড়িয়ে ২ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত নেওয়া গেলে রফতানিকারকরা উল্লেখযোগ্য শুল্কছাড় পেতে পারেন।

বিশ্বের শীর্ষ তুলা আমদানিকারক দেশের পথে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দফতর ইউএসডিএ’র সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় তুলা আমদানিকারক দেশে পরিণত হবে। এ সময় ৮৪ লাখ বেল তুলা আমদানি করা হবে, যা বৈশ্বিক তুলা বাণিজ্যের প্রায় ২০ শতাংশ।

তুলা ব্যবহারে বাংলাদেশ এখন চতুর্থ অবস্থানে। চীন, ভারত ও পাকিস্তানের পরেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এখানে বছরে ব্যবহৃত হচ্ছে ৮৫ লাখ ৫০ হাজার বেল তুলা।

তুলার বিপুল আমদানির পেছনে কারণ

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ৮৪৯টি স্পিনিং মিল রয়েছে, যাদের তুলার চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। চীনের তৈরি পোশাক ও কাপড় উৎপাদনে কাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে অনেক বিদেশি ব্র্যান্ড এখন বাংলাদেশমুখী, যার ফলে তুলার আমদানিও বাড়ছে।

তবে তুলা উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে মাত্র ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে ১.৫৩ লাখ বেল তুলা উৎপাদিত হয়েছে।

অর্থনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে তুলা আমদানিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা। শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই খরচ হয়েছে ৩৯ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসেই এই ব্যয় ছাড়িয়েছে ৩০ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে তুলা উৎপাদন বাড়ানো গেলে এই বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে বছরে একটি বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হতো।

তুলা উৎপাদন বাড়াতে নতুন পরিকল্পনা

তুলা উন্নয়ন বোর্ড ইতোমধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ লাখ বেল এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১৯ লাখ বেল তুলা উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বরেন্দ্র অঞ্চল ও চরের জমিকে তুলা চাষের আওতায় আনলে উৎপাদন ২০ লাখ বেল পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব বলে ইউএসডিএ মনে করছে।

উল্লেখ্য, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তুলা আমদানির পরিমাণ এখন শুধু একটি সংখ্যা নয়, বরং বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের এক বড় প্রতিচ্ছবি। স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো এবং উৎসভেদে কৌশলগত বৈচিত্র্য আনাই হতে পারে এ খাতের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার মূল চাবিকাঠি।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন