হোম খুলনানড়াইল নড়াইলে একটি খুনের ঘটনায় একশ বাড়ি ভাংচুর–টাকা সহ ১০ কোটি টাকার সম্পদ লুট

নড়াইলে একটি খুনের ঘটনায় একশ বাড়ি ভাংচুর–টাকা সহ ১০ কোটি টাকার সম্পদ লুট

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 48 ভিউজ

মোস্তফা কামাল:
নড়াইলের লাহুড়িয়ায় ঈদের দিনে (৩১মার্চ) একটি খুনের ঘটনা কে কেন্দ্র করে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে অন্ততঃ ১’শ বাড়ি, গোয়ালঘর ফাকা করে গরু লুটপাট সহ লুট হয়েছে অন্ততঃ ১০ কেটি টাকার সম্পদ। পুরুষশূন্য গ্রামে ৫ দিন ধরে দিনে-দুপুরেই পুলিশের উপস্থিতিতেই চলছে এসব লুটের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি ভুক্তভোগীদের । খুনের ঘটনার পর থেকে টানা ৬ দিন ধরে চলার এসব ঘটনায় ঘরছাড়া হয়েছেন অন্ততঃ ৫’শ মানুষ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গোবিন্দ পাড়া দিয়ে লাহুড়িয়া পশ্চিম পাড়া দিয়ে ঢুকতে বিলের মধ্যে চোখে পড়লো একটি ফাকা বাড়ি। দুর থেকে মনে হবে কাঠের ফ্রেমে তৈরী হচ্ছে টিনের ঘর,কাছে যেতেই বোঝা গেলো নতুন একটি টিনের ঘর কে কুপিয়ে ছিন্ন-ভিন্ন করা হয়েছে। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে অঝোরে কাদছেন দিনমজুর হাসিবুরের স্ত্রী নাসিমা,এ যেন সন্তান হারানোর কান্না। নাসিমার বাড়িঘর লুটপাট হয়েছে শুক্রবার (৪ এপিল) জুম্মা নামাজের পর, এরপর ভাংচুর করেছে বাড়িঘর আসবাবপত্র,ফলধরা লেবু আর আমগাছগুলো কেটে ফেলে প্রতিহিংসা মিটিয়েছে। যেন মহা কোন ঘূর্নিঝড় বয়ে গেছে এখানে। একটি আসবাবপত্র ও নাই বাড়িতে রান্না করে খাওয়ার মতো।
নাসিমা জানান,স্বামী আর সন্তান দুরে কৃষিশ্রমিকের কাজ করে,ঈদের দিন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। বাড়িতে আসতে গেলে মেরে তাড়িয়ে দিচ্ছে,আমরা কার কাছে বিচার চাইবো।

একটু হেটে যেতেই পরপর কয়েকটি ভাংগা তছনছ করা বাড়ি চোখে পড়লো,এ যেন যুদ্ধের পরের দৃশ্য। কোথাও ঘরের মধ্যে মালামাল লুট করে ধানের গোলা কেটে ফেলে সারাঘরে ধান আর আবর্জনার ছড়াছড়ি,কোথাও আবার ডাকাতের আক্রমনের মতো ফার্নিচারগুলো ভেঙ্গে চুরমার করে জামাকাপড় তছনছ করে ঘরভর্তি ছড়ানো।

লাহুড়িয়া পশ্চিমপাড়ায় দিনে দুপুরে বাড়িগুলোতে চলছে লুটপাট। কয়েকজন লোককে ছোটাছুটি করে অবশিষ্ট ছোট মালামালগুলো নিয়ে যেতে দেখা গেলো। সাংবাদিক দেখে কিছুটা সাহস পেয়ে দৌড়ে ভাংগা ঘরে ফিরে আসলেন কয়েকজন নারী। নিজের লুটহওয়া আর ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরেও আসতে পারছেন না ঘরমালিক। নিজের ৩টি সাজানো বাড়িঘর-সংসার আর সম্পদ লুট হয়ে যাওয়ায় গড়িয়ে কাদছেন লাহুড়িয়া পশ্চিমপাড়ার রাহিলা বেগম, ঘরের সিড়িতে বসে মাটিতে মাথা লুটিয়ে পড়ছে তার।

বললেন,আমার পয়ত্রিশ বছরের সংসার কত কষ্ট করে না খেয়ে ঘরবাড়িগুলো বানিয়েছি,একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে গেলো। আমার সব শেষ,আমরা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি,সারাজীবন ই এভাবে কাটাতে হবে।

নিজের বাড়িতে আসতে পেরে কিছুটা স্বস্তি হলেও বাড়িঘরের অবস্থা দেখে ডুকরে কেদে উঠলেন ইউনুস মোল্যার স্ত্রী নাছিমা বেগম। প্রবাসী ছেলে আব্দুল্লাহর বিয়ে সামনের মাসে। বাড়িঘর ঠিকঠাক আর বিয়ের কেনাকাটার জন্য জমানো ৭ লক্ষ টাকা পাঠিয়েছিলো সে,ভাংচুর আর লুটপাটের সাথে সেই টাকা ও লুটে নিয়েছে প্রতিপক্ষ। স্বামী সন্তান আর নিজেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ছেলের বিয়ের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলো পরিবারের।

মালয়েশিয়া প্রবাসী আব্দুল্লাহ টেলিফোনে জানান,সামনের মাসের ১০ তারিখে আমার ফ্লাইট-দেশে যাব বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করবো এখন আমার সব স্বপ্ন শেষ। বাবা-মার কি অবস্থা হবে তাই নিয়ে টেনশনে আছি। পুলিশ কারো কোন সম্পদই রক্ষা করতে পারছে না তাহলে আমাদের নিরাপত্তা কে দেবে? দেশে গেলে তো আমি খুনই হয়ে যাব।

সহায় সম্বল হারিয়ে কাদছেন পশ্চিমপাড়ার রোকসানা,কামনা,রুনা খান,খাদেজা,শিরিনার মতো শত নারী। ৩ দিনে পশ্চিমপাড়ার অন্ততঃ একশ বাড়ি ভাংচুর হয়েছে। লুট হয়েছে গরু,সোনা,টাকা সহ ২০কোটি টাকার সম্পদ। চরম অনিশ্চয়তা আর হতাশার মধ্যে পালিয়ে দিন কাটছে ৫’শ মানুষের।

পুরো এলাকা পুরুষশূন্য,রাস্তা দিয়ে হেটে গেলে মাঝেমধ্যে দুই একজন নারী চোখে পড়ছে তারা নিজের ভাঙ্গা বাড়িতে এসে অবশিষ্ট অবস্থা দেখার জন্য ছোটাছুটি করছে।পশ্চিমপাড়ার তিনমাথায় ৩ জন পুলিশকে দেখা গেলো হাতে লাঠি নিয়ে বসে আসেন। তাদের কাছে খবর আসলো একটি বাড়িতে ১৫জন নারীকে একটি ঘরের মধ্যে আটকে রেখেছে লুটপাটকারীরা। এ খবরে লাঠি হাতে ৩ পুলিশ কিছুটা গাড়িমসি করলেও পরে সাংবাদিক দেখে উঠে দাড়িয়ে রাস্তা দিয়ে হাটতে লাগলেন।পুলিশের সামনেই ভাংচুর আর লুটপাটের যত অভিযোগ,মামা বাড়িতে ভাংচুর আর লুটপাটের খবর শুনে পাশের শরশুনা গ্রাম থেকে দেখতে এসেছেন আল-আমিন। তিনি জানান,গত ৪ ৫দিন ধরে এখানে বাড়িঘর লুটপাট আর ভাংচুর চলছে। গতকাল যে টিউবয়েল দেখেছি আজ তা নেই। এখানে একটি মটর ছিলো তা নেই,এখনো চলছে লুটপাট আর পুলিশ কেবল দেখছে।

নাসিমা বেগম জানান,আমার বাড়ির মালামাল গুলো নসিমন এনে তাতে উঠায়ে নিয়ে গেলো আমি পুলিশকে গিয়ে বললাম আমার মালামাল লুট করে নিয়ে যাচ্ছে,পুলিশ আটকালো না শুধু দেখলো।

ঈদের দিন বিকালে লাহুড়িয়া পশ্চিমপাড়ায় মনিরুল জমাদ্দার ও মিল্টন জমাদ্দার গ্রæপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারে খুন হন মুক্তিযোদ্ধা আকবর শেখ,উভয় পক্ষের ১৫ জন আহত হয়। ৩ এপ্রিল নিহতের স্ত্রী আকলিমা বেগম বাদী হয়ে ১২ জনের নামে এবং অজ্ঞাত ৪/৫ জনের নামে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় দুজন সেনাসদস্যের নাম ও দেয়া হয়েছে, মামলার প্রধান আসামী লাহুড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান কামরান সিকদার। অথচ ভাংচুর আর লুটপাট হলো শত বাড়িতে।
লুটকারী পক্ষের অভিযোগ অস্বীকার।

মুক্তিযোদ্ধা আকবার শেখ যিনি খুন হয়েছেন তার বাড়ি একই পাড়ায়, সেখানে বাড়িতে লোকহন থাকলেও কেউ সামনে আসেনি। বাড়িতে ঢোকার পথে কয়েকজন যুবককে পাওয়া গেলো যারা গ্রাম দিয়ে ঘোরাফেরা করছেন। ক্যামেরা ধরতেই তারা সরে গেলেন।
এদের একজন শরিফুল ইসলাম,যিনি সম্পর্কে আকবর শেখের ভাতিজা তিনি মুখ খুললেন।হত্যার আদ্যপান্ত জানিয়ে তিনি বললেন,চাচা অত্যন্ত সৎ মানুষ ছিলেন,তিনি সবসময়ই ঝামেলা এড়িয়ে চলতেন,ঈদের দিন পুলিশের কথামতো তিনি সমঝোতা করতে রাজী হয়েও মারা গেলেন, তারেক তাকে প্রথম কোপ মারে। লুটপাট আর ভাংচুর বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমরা কোন মালই লুটপাট করিনি,আমরা আরো পুলিশের সামনে ওদের মাল উদ্ধার করে দিচ্ছি।

পুরুষশুন্য গ্রামে নির্যাতনের ভয়ে নারী শিশুরা ও বাড়িছাড়া-একদিকে নিজের বাড়ির খোজ নিতে আসছেন নারীরা,আতœীয় মহিলারা আসছেন অন্যদিকে লুটপাট কারীদের পদচারনা,দিনের বেলাতেই চলছে লুটপাট।

এলাকায় কিম্বা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে পাওয়া গেলো না লাহুড়িয়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ তুহিন পাটোয়ারী কে। ফোনে তিনি জানান,মাগুরাতে খুনের আসামী ধরতে গেছেন। পুলিশের সামনে ভাংচুর লুটপাট এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ভাংচুর যা হয়েছে তা খুনের পরদিনই হয়েছে আর কিছু চুরি হচ্ছে। আমাদের লোকবল কম,উপরে জানিয়েছি।

লোহাগড়া থানার ওসি আশিকুর রহমান বলেন,এই এলাকায় নিজের মালামাল লুট করে অন্যের উপর দোষারপের চেষ্টা করে। আমরা চেষ্টা করছি পুরো ঘটনা সামাল দেবার। এলাকায় সেনাবাহিনী,পুলিশ তো সবসময়ই টহল দিচ্ছে,পুলিশ আসামী ধরতে ব্যস্ত,পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আছে।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন