হোম অন্যান্যশিক্ষা ‘নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের নামে প্রজন্ম ধ্বংসের নীলনকশা করেছে সরকার’

শিক্ষা ডেস্ক:

নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের নামে সরকার প্রজন্ম ধ্বংসের নীলনকশা করেছে। এই শিক্ষাক্রমে আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হলে দেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক কিছু করণীয় বাদ দিয়ে শিক্ষাক্রম নাজিল করা হয়েছে। দেশের কারিকুলাম ওভারনাইট পুরো বদলে দেওয়া হয়েছে। এটা ঠিক নয়। এটা জাতির সাথে মোকারি ছাড়া কিছু নয়।

আজ শনিবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘পরিকল্পিত শিক্ষাধ্বংসের কালপঞ্জী: ১৯৭২-২০২২’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলন (শিশির) এবং সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন যৌথভাবে এ সেমিনারের আয়োজন করে।

সেমিনারে ‘পরিকল্পিত শিক্ষাধ্বংসের কালপঞ্জী: ১৯৭২-২০২২’ শীর্ষক প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেন শিশির ও সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক রাখাল রাহা। তিনি ১৯৭২ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন সরকারের পরিকল্পনা ও এর উদ্দেশ্য তুলে ধরেন।

সেখানে উল্লেখ করা হয়- ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ এর দশকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা শর্ট সিলেবাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং অন্যান্য শ্রেণিতে অটোপাস দেওয়া হয়েছিল। এটা করা হয়েছিল পাসের হার অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি করার জন্য। এর ফলে পরবর্তীতে পূর্ণ সিলেবাসের পরীক্ষায় নকল বেড়ে গিয়েছিল।

১৯৮০-৯০ এর দশকে মাধ্যমিক স্তরে ল্যাবনির্ভর বিজ্ঞান বই প্রচলন করা হয়েছিল এবং থানা বা উপজেলার বাইরে পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ফলে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী অর্ধেকে নেমে গিয়েছিল। এছাড়া, শিক্ষার্থীদের না পড়ে পাস করার প্রবণতা ও শিক্ষকদের না পড়িয়ে পাস করিয়ে দেওয়ার অসাধু তৎপরতা বেড়েছিল।

১৯৯০-২০০০ এই দশকে এমসিকিউ প্রশ্ন প্রবর্তন করা হয়েছিল। প্রাথমিক স্তরে নিয়োগ দেওয়া শিক্ষকদের ৮০ ভাগ নারী ছিল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু হয়েছে।

এমসিকিউ প্রশ্ন প্রবর্তনের কারণ ছিল- নকলের সুযোগ অবারিত থাকলেও পাসের হার কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছিল না। শিক্ষার্থীরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছিল। শিক্ষকরাও বেতন-ভাতার দাবিতে আন্দোলন করছিল। যে কারণে এমসিকিউ প্রশ্ন নিয়ে আসা হয়েছিল। যেখানে প্রশ্নব্যাংক থেকে ৫০০টি প্রশ্ন পড়লেই কমন। তারপর লিখিত পরীক্ষায় যদি ফেল করে, সেজন্য লিখিত ও এমসিকিউ মিলিয়ে ৩৩ পেলেই পাসের ব্যবস্থা করা হলো। এই প্রজেক্ট প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী পাওয়ার ক্ষেত্রে সুযোগ তৈরি করেছিল।

কোটা দিয়ে আশি ভাগ নারীকে নিয়োগের উদ্দেশ্য ছিল- শিক্ষক নিয়োগে অসাধু প্রক্রিয়ার সুযোগ রাখা গেলে ব্যাপক সংখ্যক নিম্ন মানের নারী শিক্ষক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঢোকানো সম্ভব হবে। তাদের দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার মানের উন্নয়ন নয়, অবনমন ঘটবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল- এর দ্বারা উচ্চ শিক্ষার মান কমবে। মানসম্মত শিক্ষার্থীর প্রবাহে সংকট সৃষ্টি। আর সেমিস্টার পদ্ধতি আনার ফলে গবেষণানির্ভর উচ্চশিক্ষা দেশে পাঠনির্ভর হয়ে যেটুকু ছিল তারও অবনমন ঘটেছে। উচ্চশিক্ষাও হয়ে উঠেছে নোট-গাইড, কোচিং, প্রাইভেটনির্ভর।

২০০০-১০ এই দশকে জিপিএ আনা হয়েছিল শতভাগ পাস দিয়ে ক্রমশ ভালো-মন্দের ভেদ ঘুচিয়ে সমাজে সবকিছু একাকার করে দেওয়া যাবে, সেজন্য। এই দশকে পিএসসি-জেএসসি চালু হয়েছিল দান-অনুদান পাওয়ার জন্য।

২০১০-২০ দশকে সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে আসায় নোট-গাইডের প্রচলন বেড়েছিল, কোচিং বেড়ে গিয়েছিল। প্রাথমিকের ৬টি থেকে মাধ্যমিকে ১৪টি বই ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে দেওয়ার জন্য। ছাত্রসংসদ নির্বাচন করা হয়েছিল স্কুলগুলোতে। ফলে ক্লাস কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিক্ষার্থীর পাশাপাশি অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়েছিল। স্কুলে ভর্তিতে লটারি ও কোটা চালু করার শিখন-শেখানো কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর্থিক লেনদেন বাড়ে, ম্যানেজিং কমিটি তথা সরকারি দলের লোকজনের ক্ষমতা বাড়ে।

২০২০ সালের পর চলমান দশকে সমন্বিত একমুখী শিক্ষাক্রম আনা হলো। এর উদ্দেশ্য, বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষাকে সংকুচিত করা। ফলে অভিভাবকদের ইংলিশ মিডিয়াম ও কওমির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

রাখাল রাহা বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের নামে প্রজন্মকে ধ্বংসের নীলনকশা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদ করায় অভিভাবক-শিক্ষকসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অবিলম্বে গ্রেপ্তার চারজনের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানাচ্ছি আমরা।

তিনি বলেন, এ পর্যন্ত যে কয়টি শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ও বাস্তবতা বিবর্জিত শিক্ষাক্রম হলো নতুন শিক্ষাক্রম। এ শিক্ষাক্রমের ফলে দেশে নিম্নমানের প্রচুর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল সৃষ্টি হবে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে চলে যাবে।

সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, জাপান আর ফিনল্যান্ডে খেলাধুলার নামে পড়াশোনা হয় প্রাথমিক স্তরে। ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান আর গণিত বিষয়ে সিলেবাস এভাবে করা হয়, এমনভাবে পড়ানো হয়, তা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো। সেসব দেশে শিক্ষকদের বেতন আকর্ষণীয়। যে কারণে এখানে পড়াতে অনেকেই আগ্রহী হন। আর আমাদের দেশে অন্য কোনো চাকরি না পেলে তারা প্রাথমিকের শিক্ষক হন। তাদের বেতন একজন গাড়ির ড্রাইভারের চেয়েও কম।

তিনি বলেন, শিক্ষায় বাজেট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতেই সরকারের উদ্দেশ্য একেবারে স্পষ্ট। সরকার দেশের শিক্ষার উন্নতি চায় না। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কথা বললেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তাদের জেলে দেওয়া হয়। এটা কি মগের মুল্লুক? এজন্য প্রতিবাদ প্রয়োজন। অভিভাবকরা আওয়াজ তুলুন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান বলেন, এমসিকিউ প্রশ্ন দিয়ে আমরা তোতাপাখি তৈরির চেষ্টা করেছি। শিল্প বিপ্লবের কথা বলে আমরা মেকানিক্যাল রোবটিক মানুষ তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছি। যার চারপাশের মানুষ সম্পর্কে কোনো অনুভূতি থাকবে না।

তিনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সময় গ্রাম ও শহরের পার্থক্য বিবেচনায় না নিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট চালু করা হয়েছে। এটা করার সামর্থ কয়জনের আছে? এটা অনেকের কাছে বাতুলতা ছাড়া কিছু নয়। এই শিক্ষাক্রম শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত শ্রেণিকে কেন্দ্র করে প্রণয়ন করা হয়েছে। এটা মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারবে না।

সেমিনারে আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, অধ্যাপক আবদুস সাত্তার মোল্লা, অধ্যাপক আবদুস সালাম প্রমুখ।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন