হোম তথ্যপ্রযুক্তি ধোঁকা দিয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট করছে ফেসবুক-ইউটিউব

অনলাইন ডেস্ক :

খালি হাতে এক ডুবে দুটি মাছ ধরার মজার ভিডিও–এমনসব চমকপ্রদ শিরোনাম দেখে অনেকেই ক্লিক করছেন লিঙ্কে, দেখছেন ভিডিও। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এসব ভিডিওর বেশির ভাগই মেকি ও মিথ্যা।

এমন এক ডিজিটাল দুনিয়ায় মানুষের বাস, যেখানে লাইক-কমেন্টের জন্য নীতি বিসর্জন একরকমের হরহামেশা ব্যাপার। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে জনপ্রিয়তা পেতে এমন কিছু নেই যে কনটেন্ট ক্রিয়েটররা করছেন না।

দর্শক ধরে রাখার জন্য বানাচ্ছেন মিথ্যা কনটেন্ট, ছড়াচ্ছেন গুজব, দিচ্ছেন ভুলভাল তথ্য। ব্যবহারকারীদের অনেকে আবার এসব তথ্য বিশ্বাস করে ভুগছেন নানা সমস্যায়, পড়ছেন অনাকাঙ্ক্ষিতসব বিপদে।

সম্প্রতি ডেটা রিপোর্টের এক গবেষণায় দেখা গেছে, আগের তুলনায় বর্তমানে ফেসবুক থেকে শুরু করে অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ব্যবহারকারীরা বেশি সময় দিচ্ছেন। ২০১৫ সালের এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীরা প্রতিদিন এক ঘণ্টার বেশি সময় কাটান ফেসবুকে। ২০১৭ সালের এমনই আরেক জরিপে দেখা যায়, ব্যবহারকারীদের ফেসবুকে ব্যয় করা সময়ের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট। পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০২২ সালে এসে এর সঠিক পরিমাণটা জানা না গেলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফেসবুক থেকে শুরু করে অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা দিনে দুই ঘণ্টার বেশি সময় কাটান।

ফেসবুক-ইউটিউব আসার পর থেকে মানুষের যোগাযোগ যেখানে আরও বিস্তৃত হওয়ার কথা, সেখানে তা আরও সীমাবদ্ধ ও কৃত্রিম হয়ে পড়েছে। এখন সবার হাতে একটি করে স্মার্টফোন ও সবার চোখ মোবাইলের স্ক্রিনে। হোক সেটা পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান কিংবা সামাজিক কোনো উদ্‌যাপন–সেখানে ‘গেট টুগেদার’ মানে আর গল্প নয় ‘সেলফি’ তোলা, পোস্ট দেয়া, লাইক-কমেন্ট নিয়ে মেতে থাকা।

নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা মঈনুল হাসান শোভন বলেন, ‘আগে বন্ধুরা যখন চায়ের দোকানে দেখা করতাম, চুটিয়ে আড্ডা মারতাম। আড্ডাটাই মুখ্য ছিল। সেলফি তোলা, চেক ইন দেয়া–এগুলোর দিকে খেয়াল থাকত না। কয়েক বছর যেতে না যেতেই আমাদের হাতে স্মার্টফোন এলো। এখন বড় বড় রেস্টুরেন্টে গেট টুগেদার হয়, কথা বলা বা আড্ডা দেয়ার বদলে সবাই নিজের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সময় পার হয়ে যাওয়ার পর একটা সেলফি তুলে পোস্ট দিয়ে বলি: ভালো সময় গেল। পুরো ব্যাপারটা এখন লোকদেখানো হয়ে গেছে।’

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মনির হোসেন বলেন, ‘আগে বাচ্চারা মোবাইল নিয়ে থাকত, এখন ওদের কী বলব–আমি নিজেই মোবাইল নিয়ে থাকি! দেখা যায়, আমার হাতে একটা মোবাইল, আমার স্ত্রীর হাতে আরেকটা। ইউটিউবে কীসব ভিডিও-যে দেখি! সেদিন দেখলাম কোকাকোলা দিয়ে মাছ ধরার ভিডিও। পরে গ্রামে গিয়ে আমিও চেষ্টা করে দেখলাম কোকাকোলা দিয়ে মাছ ধরা যায় কি না। মাছতো ধরতেই পারলাম না, উল্টো পরিবারের সবার কাছে হাসির খোরাক হলাম। ইউটিউবের এসব ভিডিও যে কতটা মেকি, তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করলেই বোঝা যায়।’

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরেফিন হক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার নিয়ে বলেন, ‘ফেসবুকের রিল, ইউটিউবের শর্টস, টিকটক-ইনস্টটার ভিডিও–এগুলো একবার দেখা শুরু করলে শেষ করা যায় না। অনেকবার এমন হয়েছে, পড়ার মাঝে একটু বিশ্রাম নিতে পাঁচ মিনিটের জন্য মোবাইল হাতে নিয়েছি, কিন্তু এসব মাধ্যম ঘুরতে ঘুরতে এক-দেড় ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। রাতে ভাবলাম আগে ঘুমাব, কীসের মধ্যে কী–মোবাইল হাতে নিলে কখন ৩টা-৪টা বেজে যায়–টেরই পাওয়া যায় না।’

থিবো মেরিসের বেস্টসেলার বই ডোপামিন ডিটক্স পড়লে বোঝা যায়, আমাদের হরমোনের খেলাকে ব্যবহার করে এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমনির্ভর কোম্পানিগুলো কী পরিমাণে মুনাফা লুটছে। বিনিময়ে মানুষ হারাচ্ছে মহামূল্যবান সময়, ভুগছে নানা রকমের বিষণ্নতায়।

মানবদেহের চারটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন হচ্ছে ডোপামিন, অক্সিটকিন, সেরোটনিন ও এন্ড্রোফিন। এর মধ্যে ডোপামিনকে বলা হয় লোভী হরমোন। ডোপামিন প্রতিনিয়ত আনন্দ-উল্লাসের উৎস খুঁজে বেড়ায়। অনেক সময় ডোপামিনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে অন্য হরমোনের প্রভাবকে রীতিমতো অবহেলা করা হয়।

চারপাশের ক্ষতিকর পণ্যগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যা ডোপামিন হরমোনকে উসকে দেয়। এতে মানুষ পণ্য ব্যবহার করতে গিয়ে নিজেই একসময় পণ্য হয়ে যায়। তখন আসলেই প্রশ্ন ওঠে: আমরা ফেসবুক বা ইন্টারনেট ব্যবহার করছি নাকি ইন্টারনেট বা ফেসবুক আমাদের ব্যবহার করছে।

স্মার্টফোন দুনিয়ার কর্ণধার বলা হয় স্টিভ জবসকে। যে স্টিভ জবসের অ্যাপলের জন্য বাজারে এত চাহিদা, সেই জবস নিজেই তার সন্তানদের স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দিতেন না। কারণ কী এমন উদ্ভট আচরণের? এর একমাত্র কারণ, জবস জানেন–পকেটে থাকা স্মার্টফোনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে সেটি কাজে যতটা-না ব্যবহার করবেন, তার থেকে কয়েক গুণ বেশি ব্যবহার হয় কোনো রকমের প্রয়োজন ছাড়া শুধু সময় নষ্ট করার জন্য।

আর সময় নষ্টের এ ফাঁদে অহরহ পা দিচ্ছে মানুষ। নিজের মহামূল্যবান সময়কে নষ্ট করে শারীরিক স্বাস্থ্য, মানসিক সুখ, সামাজিক জীবন, পারিবারিক আনন্দ–সবকিছু জলাঞ্জলি দিচ্ছেন ফেসবুক-ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাল্লায় পড়ে।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন