রাজনীতি ডেস্ক:
মিত্রদের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে সমঝোতার আগেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করায় চিন্তিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও বর্তমান সংসদ সদস্যদের অনেকেই নিজের আসন নিয়ে শঙ্কিত। এর মধ্যেই চলছে জাপার প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া। গতকাল শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনয়ন ফরম বিক্রি শেষ হলেও দলের চেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়ে যে কোনো সময় তা সংগ্রহ করা যাবে বলে জাপার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। অন্যদিকে, দলের অভ্যন্তরে চলমান কোন্দল নিরসন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিরোধী দলের নেতা ও জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ।
দলটির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা জানান, সরকারি দলের সঙ্গে আসন নিয়ে ফয়সালা না হওয়ায় আগামী নির্বাচনে জাপার অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী বাদ পড়তে পারেন। এ কারণে দলের একাধিক কো-চেয়ারম্যানসহ প্রথম সারির ডজনখানেক নেতার মন ভালো নেই। আগামী নির্বাচনে প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারেন বিরোধী দলের চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা, কো-চেয়ারম্যান ও ঢাকা-৬ আসনের সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদও। এ নিয়ে সবার কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। যে যার মতো করে আসন রক্ষায় দলের বাইরে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে সমঝোতার আশ্বাসে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জাপা। দলের পক্ষ থেকে ৩০০ আসনে অংশ প্রার্থিতার ঘোষণা দেওয়া হলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার পর নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার জন্য বাদবাকি আসনে জাপা প্রার্থীরা দলীয় প্রতীকে লড়বেন।
কিন্তু আওয়ামী লীগ এখন বলছে, তারা বড় জোটের কথা ভাবছে না। আজ রোববার ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হবে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল শনিবার বলেছেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট করবে কি না, সে বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রতিপক্ষ যদি বড় জোট করে, তখন জোটের কথা ভাবা হবে।’
তিনি বলেন, ‘কেন জোট করব? প্রয়োজন না থাকলে তো জোট করব না। আর যাদের সঙ্গে জোট করব, যাদের নিয়ে জোট করব, তাদের তো মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে।’
দলের আসন সমঝোতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘১৪ দলীয় জোটের শরিকদের জন্য আসনের বিষয় এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মনোনয়নের ব্যাপারে শরিকদের কথা এখনই আমরা ভাবছি না। নেত্রী (শেখ হাসিনা) ১৪ দলীয় জোটের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
আওয়ামী লীগের এমন অবস্থানের কারণে জাপার মধ্যে দুশ্চিন্তা বেড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী ঘোষণার পর জাপার সঙ্গে সমঝোতা হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে বড় রকমের সংকট তৈরি হবে। সমঝোতার আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করা কষ্টসাধ্য হবে। অন্যদিকে, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও জনসমর্থনে ঘাটতি থাকায় জাপার প্রার্থীদের মাঠে গিয়ে লড়াই করে বিজয়ী হওয়া দুষ্কর হয়ে উঠবে। এতে দুই দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত সংঘর্ষ পর্যন্ত হতে পারে। এভাবে জাপা প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করা যাবে না। ফলাফল হিসেবে শেষ পর্যন্ত পাঁচটি আসন থাকবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কিত জাপার নেতারা।
২০০৮ সালের নবম সংসদ থেকে শুরু করে তিনটি নির্বাচনেই জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতা করেছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে নবম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে মহাজোট করে বিএনপি ও তার শরিকদের মোকাবিলা করেছে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটি।
বিএনপি-জামায়াত জোট দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে ১৪ দলের সঙ্গে জোট বজায় রাখে আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি জোটে না থাকলেও তারা প্রার্থী হয়েছে, এমন ৩৪টি আসনে প্রার্থী দেয়নি তারা। সেসব আসনেই জয় পায় জাতীয় সংসদে গত দুইবারের প্রধান বিরোধী দলটি। এবারও জাপাকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আসন সমঝোতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বলে দলটির নেতাদের দাবি। কিন্তু শনিবার পর্যন্ত গণভবন থেকে জাপার ডাক পড়েনি। উল্টো সব আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করছে ক্ষমতাসীনরা।
সার্বিক বিষয়ে জাতীয় পার্টির তিন কো-চেয়ারম্যানসহ ১০ জন প্রেসিডিয়াম সদস্যের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা জানান, দলে কী হচ্ছে বোঝা মুশকিল। সবকিছু অস্পষ্ট। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সব আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা দেওয়া হবে—এ কথা বলার পর থেকে দলের নেতাদের কারও মন ভালো নেই। প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর সমঝোতা করে আসন বাগিয়ে আনার মতো রাজনৈতিক শক্তি না থাকাই চিন্তার মূল কারণ বলছেন তারা। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যারা মনোনয়ন পাবেন, তারা সহজেই মাঠ ছাড়তে চাইবেন না। এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিকভাবে বড় রকমের লোকসানের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে জাপা।
এদিকে, রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসিহ শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দলের মধ্যে চলমান সংকটের নিরসন না হলে নির্বাচনে অংশ নেবেন না বিরোধী দলের নেতা ও জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ।
তিনি বলেন, ‘রওশন এরশাদ চান, পার্টি এক হয়ে চলুক। জি এম কাদেরপন্থিদের মধ্যে দু-চারজন বিরাট পজিশনে থাকায় দলে অনুকূল পরিবেশ নেই। হাইব্রিড নেতাদের দলে কোনো অবদান নেই। তারা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। যেসব বিষয় নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে, সেগুলোর নিষ্পত্তি না হলে রওশন এরশাদ নির্বাচনে অংশ নেবেন না বলে জানিয়েছেন। বিরোধী দলের নেতা চান সব বিষয়ে সুরাহা হোক।’
রওশনপন্থিদের মধ্যে মশিউর রহমান রাঙ্গাসহ ছয় নেতা মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে গেলেও তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করে গোলাম মসিহ বলেন, ‘মশিউর রহমান রাঙ্গার পক্ষে তার মেয়ে, অন্য নেতা মাহাতাব উদ্দিন, যশোর, ঝিনাইদহসহ মোট ছয়জন নেতা জাপা চেয়ারম্যানের অফিসে গেলে ফরম না দিয়ে তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়েছে।’
তবে রওশন এরশাদ তিনটি মনোনয়ন ফরম চেয়েছেন বলে জানিয়েছেন জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। শনিবার তিনি বলেছেন, ‘দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ফোন করেছিলেন। তিনি তার (বেগম রওশন এরশাদ), পুত্র সাদ এরশাদ এবং ডা. কে আর ইসলামের জন্য তিনটি মনোনয়ন ফরম চেয়েছেন। আমরা তার কাছে মনোনয়ন ফরম পাঠিয়ে দেব। প্রয়োজন হলে আমি নিজে গিয়ে পৌঁছে দেব।’
চুন্নু বলেন, ‘জাপা জি এম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। দলে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই, সবাই ঐক্যবদ্ধ আছে।’
জাপা মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমরা তিনশ আসনেই লাঙ্গল নিয়ে নির্বাচন করব। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব কৌশল থাকে। আমরা আমাদের নিজস্ব কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। যারা দলে দীর্ঘদিন অবদান রেখেছেন, এলাকায় জনপ্রিয়তা, দেশ ও মানুষের প্রতি তার কতটুকু দরদ আছে—এসব বিবেচনা করেই মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে।’
এদিকে গতকাল শনিবার জাপা চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে বরিশাল, খুলনা ও সিলেট বিভাগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। আজ রোবাবার ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম বিভাগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হবে।
দলের প্রার্থী তালিকার বিষয়ে চুন্নু বলেন, ‘আশা করি, ২৭ নভেম্বর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করতে পারব। আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শেষ হয়েছে। তবে বিভিন্ন কারণে যারা ফরম তুলতে পারেননি, তারা পার্টি চেয়ারম্যানের অনুমতি সাপেক্ষে মনোনয়ন ফরম তুলতে পারছেন।’