জাতীয় ডেস্ক:
ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্যেই প্রতিমাসে চলছে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য বিক্রি। কার্ড দেয়ার দায়িত্বে থাকা জনপ্রতিনিধিরাই জানাচ্ছেন, হাজার হাজার পরিবারের রয়েছে একাধিক কার্ড। অথচ সব কার্ডের বিপরীতেই পণ্য বরাদ্দ দিচ্ছে টিসিবি!
শনিবার (১৪ অক্টোরব) দুপুরে রাজধানীর একটি ওয়ার্ডের টিসিবির কার্যক্রমের সরেজমিন চিত্র বলছে, টিসিবির পণ্য কিনতে এসেছেন যারা তাদেরই একজনের হাতে দেখা মেলে দুইটি কার্ডের। তার হাতে থাকা দুইটি কার্ডের বিষয়ে এই প্রতিনিধি জানতে চাইলে উত্তরে তিনি জানান, স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই রয়েছে এই ফ্যামিলি কার্ড।
তিনি বলেন, ফ্যামিলি কার্ড আমার স্ত্রীর একটি, আর আমার একটি। আমার পরিবার দুইটি। দেখা গেছে, আমার মায়ের কার্ডটি করা হয়নি, তাই আমার স্ত্রীর জন্য ফ্যামিলি কার্ড করা হয়েছে।
এদিকে একজনের হাতে মিললো ১২টি কার্ডের বান্ডেল। এমন অনেকের হাতেই দেখা গেল একাধিক কার্ড, অবশ্য এর পেছনে যুক্তিও দাঁড় করালেন তারা। একজন বললেন, তার হাতে থাকা দুইটি কার্ডের মধ্যে একটি তার ও আরেকটি তার ছেলের। আরেকজন বললেন, তার হাতে থাকা কার্ডের বান্ডেলে একটি তার আর অন্যগুলো তার হাতে অন্যরা রেখে চা খেতে গিয়েছেন।
এক টিসিবি উপকারভোগীর হাতে দেখা মেলে ৩টি ফ্যামিলি কার্ডের। এবিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার হাতে থাকা কার্ডের একটি আমার ছেলের, আরেকটি আমার মেয়ের এবং একটি আমার নিজের।’
কয়েকটি স্পট ঘুরে পাওয়া গেল, কার্ড প্রচলনের ১৪ মাস পরে এসেও অনেকের কার্ডেই নেই পূর্ণাঙ্গ তথ্য। কোনো কোনো কার্ডে আবার দেখা গেল আগের তথ্য মুছে বসানো হয়েছে নতুন তথ্য। এবিষয়ে এক ফ্যামিলি কার্ডধারী বলেন, সবগুলোতেই এরকম কাটাছেঁড়া করে আমাদের দেয়া হয়েছে।
মাসের পর মাস ধরে চলা এই বিক্রি কার্যক্রমের কার্ড তৈরি ও পণ্য বিক্রিতে কেমন অনিয়ম হয়েছে, তা আঁচ করার জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কয়েকটি ওয়ার্ডের সঙ্গে কথা বলেছে সময় সংবাদ। এসময় জানা যায়, তথ্য যাচাই করতে গিয়ে বড় অংকের পরিবারে একাধিক কার্ড থাকার প্রমাণ মিলছে।
একই পরিবারের একাধিক কার্ড থাকার কথা জানিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড-৬ এর কাউন্সিলর বি এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, ১০ হাজার ৩০০ এর মধ্যে একাধিক কার্ড থাকার কারণে ৪ হাজার কার্ডই বাদ দেয়া হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড-২ এর কাউন্সিলর মো. আনিসুর রহমান সরকার বলেন, ‘প্রায় ২ হাজার ৯৯৫টি কার্ড আমরা দিতে পারিনি। এ কার্ডগুলো হয়তো কারও দুইটি করে ছিল, বা কেউ নেয়নি বা বাসা ছেড়ে চলে গেছে, তাই আমরা দিতে পারিনি।’
তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, নিয়ম ভেঙে করা ফ্যামিলি কার্ডের বিপরীতেও কী পণ্য বরাদ্দ দিচ্ছে টিসিবি? জবাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড-৬ এর কাউন্সিলর বি এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রায় ১৪ মাস ধরে আমাদের এই বিক্রি কার্যক্রম চলছে। কিন্তু টিসিবি থেকে তো বলেনি যে, একাধিক কার্ড থাকলে জমা দিতে হবে। তারা বললে তো এই কার্ডগুলো ব্লক করা হবে।
এদিকে সংকটকালে ভর্তুকি দেয়া এমন কার্যক্রমে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে সরকারকে কঠোর হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর। তিনি বলেন, ‘টিসিবির তালিকা ঠিকভাবে হচ্ছে না বা ভুল হচ্ছে, এক্ষেত্রে দায়ী বা দোষী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’
অন্যদিকে ভুল তথ্যে ফ্যামিলি কার্ড তৈরিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে টিসিবি। এবিষয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আরিফুল হাসান বলেন, এখানে ভুল তথ্য দেয়ার সুযোগ নেই। তবে এর পরও যদি এরকম কিছু পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এটি স্পষ্ট যে, টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে বিক্রি কার্যক্রমে অপচয় বা দুর্নীতি হচ্ছে। কিন্তু প্রতি মাসে ঠিক কত কোটি টাকার দুর্নীতি হচ্ছে, সেই হিসাব নেই। কিন্তু যারা দায়িত্বশীল তাদের কাছে হিসাব চান তারা, যাদের করের টাকায় প্রতি মাসে ঘটা করে চালানো হয় এই ভর্তুকি কার্যক্রম।
এ মাসের টিসিবির বিক্রি কার্যক্রমে ১০০ টাকা দরে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বা রাইসব্রান তেল, ৬০ টাকা দরে মসুর ডাল এবং ৩০ টাকা দরে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ফ্যামিলি কার্ডধারীরা সর্বোচ্চ ২ লিটার সয়াবিন তেল বা রাইসব্রান তেল, সর্বোচ্চ ২ কেজি মসুর ডাল এবং সর্বোচ্চ ৫ কেজি চাল কিনতে পারবেন। এছাড়া প্রাপ্যতা সাপেক্ষে কয়েকটি স্থানে ৭০ টাকা দরে এক কেজি চিনিও বিক্রি করছে টিসিবি।
এদিকে চলতি মাসে ঢাকা মহানগরে আমদানি করা পেঁয়াজ প্রাপ্তি সাপেক্ষে ৩৫ টাকা দরে সর্বোচ্চ ২ কেজি করে উপকারভোগীদের দেয়া হচ্ছে।
উল্লেখ্য, রোববার (১৫ অক্টোরব) রাজধানীর ধানমন্ডি লেক (ডিঙ্গি) সংলগ্ন ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের সামনে দেশব্যাপী অক্টোবর মাসের এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর কাছে চালসহ টিসিবির পণ্য সাশ্রয় মূল্যে বিক্রয় কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।