কক্সবাজারের নাজিরারটেক উপকূলে ট্রলার থেকে ১০ মরদেহ উদ্ধারের পর থেকে ঘটনার রহস্য উদঘাটনে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে পুলিশ। এ ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনায় নিহত ট্রলার মালিক সামশুল আলম প্রকাশ সামশু মাঝির স্ত্রী রোকেয়া বেগম বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর থানায় মামলা করেছেন।
মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আয়োজিত এক প্রেসব্রিফিং এ এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম।
তিনি জানান, মামলার এজাহারে চার জনের নাম উল্লেখ করে ৬০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে এ মামলাটি করা হয়েছে। মামলার এজাহারভূক্ত ১ নম্বর আসামি মাতারবাড়ির এলাকার ট্রলার মালিক বাইট্টা কামাল ও ৪ নম্বর আসামি ট্রলার মাঝি করিম সিকদারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এরা এ ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এদের আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ডের আবেদন করে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তিনি জানিয়েছেন, ঘটনাটির কোন প্রকার ক্লু এ পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখে পুলিশ গুরুত্ব সহকারে তদন্ত শুরু করেছে। মামলার স্বার্থে নিহতদের স্বজন এবং ঘটনায় সংশ্লিষ্ট যাদের নাম পাওয়া যাচ্ছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকে বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলে ঘটনার মূল রহস্য বের করা সম্ভব হবে। তদন্ত করেই এসব প্রশ্নের উত্তর বের করা হবে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, রোববার গুরা মিয়া নামের এক ব্যক্তির মালিকানাধীন একটি ট্রলার সাগরে ভাসমান থাকা ট্রলারটি নাজিরারটেক উপকূলে নিয়ে আসে। আর ওই ট্রলারের হিমঘরে হাত-পা বাঁধা ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই ট্রলারটির মালিক মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের হরিয়ারছড়া এলাকার ছনখোলা পাড়ার মৃত রফিক উদ্দিনের ছেলে সামশুল আলম প্রকাশ সামশু মাঝি। যার মরদেহ গ্রহণ করেছেন তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম। ইতোমধ্যে দায়ের হওয়া মামলার বাদীও তিনি। রোকেয়া বেগমও স্বীকার করেছেন ট্রলারটি মালিক তার স্বামী। কিন্তু সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া প্রতিটি ট্রলারের নাম থাকে। আর এসব ট্রলার মালিক সমিতির সদস্যও হন, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে নিবন্ধনও করতে হয়। তবে সামশু মাঝির ট্রলারটির কোন নাম ছিল না।
কক্সবাজার জেলার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, উদ্ধার হওয়া ট্রলারটির গায়ে কোন নাম ছিল না। ট্রলারটি সমিতির আওতাভুক্তও নয়। এ পর্যন্ত মরদেহ পাওয়া ব্যক্তিরা প্রকৃত জেলেদের কিনা এটা নিয়ে সন্দেহও রয়েছে তাদের।
তিনি জানান, স্বাভাবিকভাবে জলদস্যূতার সঙ্গে জড়িত ট্রলার ও ডাকাতরা এমন হয়।
তাহলে কি আগে থেকে প্রচার হওয়া তথ্য সত্য? এমন প্রশ্নের উত্তর চায় পুলিশ।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ১১ এপ্রিল সাগর থেকে আসা ছয় জন জেলে নিহতের স্বজনদের জানিয়েছিলেন, ডাকাতি করতে গিয়ে হামলার শিকার হন তারা। পরে তাদের হিমঘরে বন্দি করে ট্রলারটি ভাসিয়ে দেয়া হয়।
এই ছয়জন হলেন-মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নের পূর্ব আঁধারঘোনা গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে মো. হায়াত। একই গ্রামের সালাহ আহমদের ছেলে আব্দুল মালেক ও মোহাম্মদ রিদুয়ান, দানু মিয়ার ছেলে আব্দুল মান্নান, আকবর আলীর ছেলে মাহবুব আলম, মো. শরীফের ছেলে নুরুস সামাদ, ছামিরাঘোনা এলাকার আবু জাফরের ছেলে নজরুল ও অফিস পাড়া এলাকার হেলাল উদ্দিন।
ছয় জনের তথ্য মতে প্রচার ছিল, সামশু মাঝির ট্রলারে করে ৭ এপ্রিল সাগরে যান ১৯ মাঝি মাল্লা। গভীর সাগরে ৯ এপ্রিল ফিশিং ট্রলারে ডাকাতি করার অভিযোগে মাতারবাড়ির এলাকার জনৈক বাইট্টা কামাল, একই এলাকার নূর হোসাইন বহদ্দারের মালিকানাধীন দুটি ট্রলার এবং তাদের সঙ্গে থাকা মাতারবাড়ির আবছার মাঝি এবং বাবুল মাঝির ট্রলারসহ আরও ৪/৫ টি ফিশিং ট্রলার সামশু মাঝির ট্রলার ধাওয়া করে। এ সময় মাঝি-মাল্লাদের হিমঘরে আটকে ট্রলারটি পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়।
এ তথ্য ৬ জেলে কিভাবে জেনেছেন আর মাতারবাড়ির যে ৪ ট্রলার মালিক ও মাঝির কথা এসেছে তারা কারা? এদের মধ্যে ২ জনকে গ্রেপ্তার করার পর আরও জিজ্ঞাসাবাদ জরুরি বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার।
পুলিশ সুপার জানান, নানাভাবে নানা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সব বিবেচনা করে মামলার তদন্ত চলছে। এ ঘটনার রহস্য বের করতে পুলিশের ৫ টি দল কাজ করছে। ইতিমধ্যে নুরুল কবির ও সামশু মাঝির বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও হত্যা মামলা পাওয়া গেছে। সব বিবেচনায় তদন্ত চলছে। নিহতদের মধ্যে এমন কয়েকজন পাওয়া গেছে যারা জীবনে কখনও সাগরে যাননি বলে স্বজনরা দাবি করছেন। নিহত নূরুল কবির এদের ডেকে সাগরে নিয়ে গেছে। সব বিবেচনায় মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম চলছে।
এর বাইরে এ ঘটনায় মাদক সংক্রান্ত একটি বিষয়টিও সামনে এসেছে। এটাও তদন্তে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এর মধ্যে ১১ এপ্রিল ফিরে নিখোঁজের তথ্য দেয়া ছয় জেলে ও মাতারবাড়ির অন্যান্য ট্রলার মালিক নূর হোসাইন বহদ্দার, আবছার মাঝি এবং বাবুল মাঝিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আটক করে নিয়ে গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
তবে এ সংক্রান্ত কোন তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন, পুলিশ সুপার।
এদিকে, ছয় জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করলেও মর্গে রয়ে গেছে চার জনের মরদেহ। ডিএনএ পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে এ চার জনের পরিচয়। এরপরই চার জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হবে বলে জানান এসপি।
তবে প্রাথমিকভাবে এ চার জনকে শাপলাপুর ইউনিয়নের মিঠাছড়ি গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে সাইফুল ইসলাম (১৮), সাহাব মিয়ার ছেলে সাইফুল্লাহ (২৩), মোহাম্মদ আলীর ছেলে পারভেজ মোশাররফ (১৪), চকরিয়া উপজেলার কোনাখালী ইউনিয়নের কবির হোসাইনের ছেলে সাইফুল ইসলাম (৩৪) বলে স্বজনরা দাবি করেছেন।
হস্তান্তর হওয়া মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের ছনখোলা পাড়ার রফিক মিয়ার ছেলে সামশুল আলম প্রকাশ সামশু মাঝি, চকরিয়া পৌরসভার চিরিঙ্গা এলাকার জসিম উদ্দীনের ছেলে তারেক, শাপলাপুর ইউনিয়নের মিঠাছড়ি গ্রামের জাফর আলমের ছেলে সওকত উল্লাহ, চকরিয়া উপজেলার কোনাখালী ইউনিয়নের শাহ আলমের ছেলে মোহাম্মদ শাহজাহান, শাপলাপুর ইউনিয়নের মিঠাছড়ি গ্রামের মুসা আলীর ছেলে গণি ওসমান, একই ইউনিয়নের মোহাম্মদ হোসানের ছেলে নূরুল কবিরের মরদেহ নামাজে জানাজা শেষে স্ব স্ব এলাকায় দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
সুত্র: সময় টিভি