হোম ফিচার টিকটক: ক্রিয়েটিভিটি নাকি মানসিক রোগ?

বিনোদন ডেস্ক :

গান কিংবা রম্য সংলাপের সঙ্গে নিজের ব্যাঙ্গাত্মক মুখভঙ্গি আর ঠোঁট মিলিয়ে ১৫ থেকে ৬০ সেকেন্ডের ভিডিও বানানোর নাম টিকটক। বেড রুম থেকে বাড়ির ছাদ, স্কুল আঙ্গিনা থেকে সদর ঘাট! কোনো স্থানই বাদ নেই টিকটকারদের হাত থেকে। টিকটকের এই খেলায় মেতে আছে শিক্ষার্থী, শিল্পী, তারকা, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

ব্যাঙ্গাত্মক রম্য সংলাপের আড়ালে আসলে কী হচ্ছে টিকটকে? অ্যাপসটি নিয়ে ঘাটাঘাটি করলে দেখা যায়, অশ্লীলতার এপিঠ আর ওপিঠ হলো এই মাধ্যমটি। শরীরের বিশেষ অংশ প্রদর্শন, অদ্ভুত ও অযৌক্তিক সংলাপ, গুজব বা উদ্ভট চুলের প্রদর্শনসহ নানারকম পাগলামির মাধ্যমে কে কত ভিউ আর ফলোয়ার বাড়াতে পারে তার এক অঘোষিত প্রতিযোগিতা। যদিও এসব বিষয় মানতে নারাজ টিকটকাররা।

তারা বলেন, টিকটক করার কারণ হচ্ছে আমাদের বিনোদনের কোনো জায়গা নেই। মাঠঘাট নেই। খেলার স্থান নেই। সবখানেই বড় বড় দালান বানানো হচ্ছে। এ কারণে আমরা টিকটকের প্রতি আরও বেশি ঝুঁকছি। তারচেয়ে বড় কথা, ভারতীয় চ্যানেলগুলোই আমাদের এসব করতে আরও বেশি উৎসাহ দিচ্ছে। টিকটক বন্ধ করতে হলে আগে ভারতীয় চ্যানেলগুলো এখানে প্রচার বন্ধ করতে হবে।

টিকটকারদের আছে নানা রকম গ্যাং বা গ্রুপ। যোগাযোগের জন্য রয়েছে ম্যাসেঞ্জার চ্যাট গ্রুপ যেখানে নানারকম অবৈধ কর্মকাণ্ডের আলাপ আলোচনা চলে রাতভর। অভিযোগ আছে, টিকটক ব্যবহার করে অনেকেই জড়িয়ে পড়েছেন চাঁদাবাজি, মাদকসহ মেয়ে সংক্রান্ত নানা অবৈধ কাজে। টিকটক পার্টির নামে জুয়ার আসর, মাদক কেনাবেচা আর সেবনের কার্যক্রমও চলে হরহামেশা। এসবের সঙ্গে গুটিকয়েক টিকটকার সম্পৃক্ত বলেও শিকার করেছেন টিকটকাররাই।

এ প্রসঙ্গে একাধিক টিকটকার সময় সংবাদকে বলেন, ম্যাসেঞ্জারসহ নানামাধ্যমেই এ ধরনের গ্রুপ আছে। তাদের অনেককেই আমরা চিনি না। গ্রুপে যুক্ত করার পর আমাদের সাথে পরিচিত হয়। পার্টির জন্য আমন্ত্রণ জানায়। সারারাত নানা ইস্যুতে ভিডিও কলে কথা বলে। পার্টিতে কি কি হবে এ ধরনের লোভনীয় অফার দেয়।

টিকটকার শাকিল এসব অভিযোগের সত্যতা শিকার করে বলেন, অনেকেই এখন টিকটক ব্যবহার করে খারাপ কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছে। কেউ অশ্লীল ভিডিও বানাচ্ছে, কেউ মাদক কারবারীর সাথে যুক্ত হচ্ছে আবার কেউ কেউ কিশোর গ্যাংয়ের সাথেও যুক্ত হচ্ছেন।

এদিকে রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে টিকটকারদের শুটিংয়ে বিরক্ত অনেকেই। ক্ষোভ জানিয়ে তারা বলেন, এদের কারণে রাস্তাঘাটে হাঁটাই যায় না। যেখানে সেখানে এরা শুটিং করতে নেমে যায়। এখানে একটি রাস্তা আছে তার নামই হয়ে গেছে টিকটক পাড়া। পুলিশও এদের কিছু বলে না। দিন রাত এভাবে রাস্তা দখল করে রাখলে ফুটপাথে হাঁটবো কীভাবে? হয় এসব টিকটক বন্ধ করা হোক নয়তো এদের আলাদা স্থান দেওয়া হোক যেখানে তারা এসব করতে পারবে।

উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েদের বাস্তবতা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে এই টিকটক। অতিরিক্ত টিকটক ব্যবহারের ফলে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, বাস্তবতার প্রতি বিমুখতা, মনস্তাত্ত্বিক অবক্ষয় ও চারিত্রিক অবনতির মতো ভয়ানক জটিল মানসিক সমস্যাও দেখা দিয়েছে। সন্তানদের এমন হাল নিয়ে কতটা অবগত অভিভাবকরা?

এ প্রসঙ্গে সৈকত ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, ভাইরাল হওয়ার একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে এখন। ভাইরাল হওয়ার জন্য টিকটককে একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসবের কারণে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টটাও অনেক বেড়ে গেছে। প্রচুর ক্রাইম হচ্ছে। টিকটকার মেয়েদের জন্য বিয়ের প্রস্তাব গেলেও অনেকে না বলে দিচ্ছেন। বলছেন, এসব মেয়েকে বিয়ে করা যায় না।

তিনি আরও বলেন, টিকটকের মধ্যে সত্যি বললে আমি পজেটিভ কিছু পাইনি। এদের কাউকে আমার স্বাভাবিক বলেও মনে হয় না।

টিকটক এক দিকে যেমন অশ্লীল কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটাচ্ছে অন্য দিকে তৈরি করছে মানসিক বৈকল্য। অর্থহীন এ প্রতিযোগিতায় নিজেকে এগিয়ে রাখতে অনেকে নিচ্ছেন জীবনের ঝুঁকি। ঘটেছে প্রাণহানির ঘটনাও। অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করে নিজেকে আলোচনা আনার এমন প্রবণতাকে ভয়াবহ মানসিক অসুস্থতা বলছেন মনোবিদরা।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, টিকটক একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হলেও দিন দিন এর অপব্যবহার বেড়েই চলছে। টিকটকে আসক্তি একটা মানসিক রোগ। আর মানসিক রোগ মানেই নানা ধরনের সংকট বেড়ে যাওয়া। যার প্রমাণ আমরা পত্রিকা বা মিডিয়ায় দেখতে পাচ্ছি।টিকটকারদের কারণে সমাজে নানা ধরনের অপরাধ অনেক বেড়ে গেছে। তারা নিজেরাও মানসিক সংকটে ভুগছে তেমনি সমাজেও নানা অশান্তি, ঝামেলা আর বিবাদ তৈরি করছে।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই বলছে এসব আসক্তি একটা মানসিক রোগ। সেটা মাদকে আসক্তি হোক আর টিকটকে আসক্তিই হোক। এটাকে বলা হয় আচরণগত আসক্তি। তাই তাদের সুস্থ করতে হলে উপযুক্ত চিকিৎসা করাতে হবে। মনো চিকিৎসা ও কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে তাদের সুস্থ করা সম্ভব। একইসাথে তাদের বাবা-মায়েদেরও আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। সবাই মিলে এক সাথে চেষ্টা করলে এদের সবাইকে সুস্থ করা সম্ভব।

২০১৬ সালে চীনে টিকটকের জন্ম। অথচ সেই চীনেই টিকটক নিষিদ্ধ। ২০২১ সালে প্লে স্টোরে সর্বাধিক ডাউনলোডের খেতাবটিও গেছে টিকটকের ঘরে। তবে অতিমাত্রায় টিকটকের ব্যবহার একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। এই সামাজিক ব্যাধিকে রুখতে হলে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে অভিভাবকদের। সচেতন হতে হবে খোদ টিকটকারদেরই।

 

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন