ঝিনাইদহ অফিস :
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে যার বেশীর ভাগই আজ ধ্বংসের পথে। তবে এলাকাবাসীর উদ্যোগে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় নলডাঙ্গা রাজার ৮টি সুদৃশ্য মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে।
যে রাজার রাজ্য রক্ষার জন্য সৈন্য বাহিনী ছিল, সে রাজা, রাজ্য বা সৈন্য বাহিনী কোনটিই আজ নেই। রাজ প্রাসাদ রক্ষার জন্য চারিদিকে যে পরিখা খনন করা হয়েছিল, সেই প্রাসাদও আজ নেই। শত্রুর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেতে রাজপ্রাসাদ থেকে বেগবতী নদীর সাথে যে সংযোগ সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিল তাও মাটির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৮টি সুদৃশ্য মন্দির।
ঐতিহ্যবাহী নলডাঙ্গা রাজবাড়ীটি নিলামে বিক্রি করায় যেখানে সুসজ্জিত প্রাসাদ ছিল সেখানে আজ ফসলের আবাদ হয়। দেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ অতি প্রাচীন এই ইতিহাস আর ঐতিহ্য রক্ষায় উদ্যোগী হলে এটি হতে পারত এক অমূল্য সম্পদ। ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে চার কিলোমিটার উত্তরে এই প্রাচীন রাজ বাড়ীর অবস্খান। প্রকৃতপক্ষে এই নলডাঙ্গা রাজ প্রাসাদ আর রাজবংশের ইতিহাস কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে পাকিস্তান আমলেই।
সরেজমিনে দেখা যায়, বেগবতী নদীর ধারে বহুকাল ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কালীমাতা মন্দির, লক্ষী মন্দির, গণেশ মন্দির, দুর্গা মন্দির, তারামণি মন্দির, বিষ্ণু মন্দির, রাজেশ্বরী মন্দিরসহ বিলুপ্ত প্রায় সুদৃশ্য আটটি মন্দির। সাম্প্রতি স্খানীয় এলাকাবাসীর উদ্যোগে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় মন্দিরগুলোর ধবংসাবশেষ সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে।
স্খানীয় মন্দির সংস্কার কমিটির সাধারণ সম্পাদক অতুল অধিকারী জানান, ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন থেকে ২০০৬-০৭ ইং অর্থ বছরে সরকারী বরাদ্দকৃত ৭৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয় শ্রী শ্রী লক্ষীদেবী মন্দির উন্নয়নের জন্য এবং শিব মন্দির উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করা হয় ৬৫ হাজার টাকা।
এরপর স্খানীয় লোকজন নিজেদের টাকায় ১৬৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দিরসহ কালীমাতা মন্দির, লক্ষ্মী মন্দির, তারা মন্দির এবং দ্বিতল বিশিষ্ট বিষäু মন্দিরের সংস্কার কাজ ইতিমধ্যে শেষ করেছে। সকলের সহযোগতিায় বাকি মন্দিরগুলো সংস্কারের কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে পারবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
লোকমুখে এবং ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, প্রায় পাঁচশত বছর আগে এই রাজবংশের আদি পুরুষ ভট্ররায়ন ফরিদপুরের তেলিহাটি পরগনার অধীন ভবরাসুর গ্রামে বসবাস করতেন। তারই এক উত্তরসুরী বিষ্ণুদাস হাজরা নলডাঙ্গার রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নবাবের চাকরী করে হাজরা উপাধি পান। তার পিতার নাম ছিল মাধব শুভরাজ খান। তিনিও নবাবের চাকরী করতেন। বৃদ্ধ বয়সে বিষ্ণুদাস ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হয়ে সন্ন্যাসী হন এবং ফরিদপুরের ভবরাসুর হতে নলডাঙ্গার নিকট খড়াসিং গ্রামে চলে আসেন।
এবং বেগবতী নদীর তীরে এক জঙ্গলে তপস্যা শুরু করেন। ১৫৯০ সালে মোঘল সুবেদার মানসিংহ বঙ্গ বিজয়ের পর নৌকা যোগে বেগবতী নদী দিয়ে রাজধানী রাজমহলে যাচ্ছিলেন। তার সৈন্যরা পথিমধ্যে রসদ সংগ্রহের জন্য অনুসন্ধানে বের হয়ে বিষ্ণুদাস সন্ন্যাসীকে তপস্যারত অবস্খায় দেখতে পান। এসময় বিষ্ণুদাস সৈন্যদের খুব দ্রুত রসদ সংগ্রহ করে দেন। এতে সুবেদার মানসিংহ খুশি হয়ে সন্ন্যাসীকে পার্শবর্তী পাঁচটি গ্রাম দান করে যান। এই গ্রামগুলির সমন্বয়ে প্রথমে হাজরাহাটি জমিদারী এবং ক্রমান্বয়ে তা নলডাঙ্গা রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
তখন এই এলাকাটি নল জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল তাই স্থানটি নলডাঙ্গা নামেই অভিহিত হয়। এরপর প্রায় তিনশত বছর এ বংশের বিভিন্ন শাসক বিভিন্ন সময়ে শাসন করেন। এবং বিভিন্ন শাসক বিভিন্ন সময়ে বিলুপ্তপ্রায় মন্দিরগুলো প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৮৭০ সালে রাজা ইন্দু ভূষণ যক্ষা রোগে মারা গেলে তার নাবালক দত্তক পুত্র রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় রাজ্যের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন।
এবং তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন আজকের এই বিলুপ্তপ্রায় কয়েকটি মন্দির যা কালের সাক্ষী হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বেগবতী নদীর তীরে। প্রকৃতপক্ষে রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় ছিলেন বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার কুমড়াবাড়িয়া গ্রামের গুরুগোবিন্দ ঘোষালের কনিষ্ঠ পুত্র। তিনি রাজ বংশের কেউ ছিলেন না। রাজা ইন্দু ভূষণ মারা যাওয়ার দীর্ঘ নয় বছর পর ১৮৭৯ সালে পূর্ণ জমিদারী ভার গ্রহণ করেন রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় ।
১৯১৩ সালে তিনি রাজা বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন। সে সময় তিনি শিক্ষার প্রতি অনুরাগী হয়ে পিতা-মাতার নামে ইন্দুভূষণ ও মধুমতি বৃত্তি চালু করেন যা তখনকার সময়ে এক বিরল ঘটনা ছিল। তিনিই ১৮৮২সালে রাজবাড়ীর নিকট আজকের নলডাঙ্গা ভূষণ হাই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি এখন কালীগঞ্জের প্রাণ কেন্দ্রে অবস্খিত। রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় ১৯৪১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী ভারতের কাশিতে মারা যান।