কঞ্জন কান্তি চক্রবর্তী, ঝালকাঠি :
পেয়ারা বাগানে পৌঁছে চোখে বিস্ময়। হলুদ, সবুজ শত শত পেয়ারা ঝুলে আছে, গাছভর্তি পেয়ারা। আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগান একটু অন্যরকম। ছোট ছোট খাল। তার মাঝে উঁচু জায়গা, সেখানটায় পেয়ারা গাছ সারি সারি।
এ বছর মহমারি করোনার কারনে ঝালকাঠির ভাসমান পেয়ারার বাজার জমে ওঠার সম্ভাবনা কম থাকায় বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কায় রয়েছেন চাষী ও পাইকাররা। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো আগে-ভাগে বাগান কিনে রাখায় লোকসানের আশঙ্কায় রয়েছেন পাইকাররা। যে সব চাষীরা বাগান বিক্রি করেনি তারা বলছে এবার পেয়ারা বাগানেই পচেঁ থাকার সম্ভাবনা বেশি।
বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরিশালের প্রায় ৫১ গ্রামে পেয়ারার চাষ হয়। তিন জেলার হাজার হাজার মানুষের কাছে পেয়ারা আর্থিক সংকট লাঘব ও জীবিকার অবলম্বন। এই আষাঢ়-শ্রাবণের ভরা বর্ষায় এসব এলাকার নদী-খাল জুড়ে পেয়ারার সমারোহ। দেরিতে ফুল থেকে ফল আসায় আষাঢ়ের শেষের দিকেই পরিপক্ক হয়ে পেয়ারা বিক্রি শুরু হবে বলে জানায় চাষীরা।
তাই বিক্রি মৌসুমের আগেই এবার লকডাউন শুরু হওয়ায় পাইকার ও চাষীরা মারাত্মক দুঃশ্চিন্তায় পড়েছে। কারন সড়ক পথে পেয়ারা পরিবহন করতে না পারায় প্রতিবারের মতো এবার পাইকাররা আসবে না। অপরদিকে ঝালকাঠির ভাসমান পেয়ারা হাট দেখতে দেশ বিদেশের পর্যটকরা এসে এখান থেকে প্রচুর টাকার পেয়ার কিনে নিয়ে যায়। করোনার কারনে এবার তা হচ্ছে না বলে জানান চাষীরা।
এখানকার পেয়ারা চাষীদের সাথে কথা বলে আরো জানাযায়, বরিশাল জেলার বানারীপাড়া, ঝালকাঠি জেলার ঝালকাঠি সদর ও পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি ঘিরেই মূলত পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ। বরিশাল জেলার বানারীপাড়ার ১২ গ্রামে ৯৩৭ হেক্টর, ঝালকাঠী জেলার ১৩ গ্রামে ৩৫০ হেক্টর জমিতে, স্বরূপকাঠীর ২৬ গ্রামের ৬৪৫ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়।
এসব এলাকার মধ্যে ঝালকাঠির কীর্তিপাশা, ভিমরুলী, শতদশকাঠী, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাপুড়াকাঠী, জগদীশপুর, মীরকাঠী, শাখা গাছির, হিমানন্দকাঠি, আদাকাঠি, রামপুর, শিমুলেশ্বর গ্রামের বৃহৎ অংশজুড়ে বাণিজ্যিকভাবে যুগ যুগ ধরে পেয়ারার চাষ হচ্ছে। পেয়ারার চাষ, ব্যবসা ও বাজারজাত করতে রয়েছে কয়েক হাজার মৌসুমী পাইকার এবং শ্রমিক। এ সময় ঝালকাঠির অন্তত ২০ টি স্থানে পেয়ারার মৌসুমী মোকামের সৃষ্টি হয়।
প্রতিটি মোকামে মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার মণ পেয়ারা কেনা-বেচা হয়ে থাকে। জ্যৈষ্ঠের শেষ থেকে ভাদ্রের শেষ এই তিন মাস পেয়ারার মৌসুম। তবে ভরা মৌসুম শ্রাবণ মাসজুড়ে। এরপর ক্রমশ কমতে থাকে পেয়ারার ফলন। চৈত্র বৈশাখের মধ্যেই পেয়ারা চাষিরা বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সাধারণত ছোট ছোট খাল, নাল দিয়ে বাগান গুলো মূলভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে।
চাষিরা মৃত্যপ্রায় গাছের ডাল কেটে, মাটি আলগা করে পেয়ারা গাছের আলাদা যতœ নেয়। বাগানের চতুর্দিক জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নালার মাটি পেয়ারা গাছের গোড়ায় দেয়া হয়। পেয়ারা গাছে তেমন কোন সার বা আলাদা করে কিছু দেবার প্রয়োজন নেই ,শুধু পরিচর্যাই যথেষ্ট। সারাবছর তেমন কোন কিছু করার দরকার হয় না। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসেই পেয়ারা গাছে ফুল আসতে শুরু করে। তবে বৃষ্টি শুরু না হলে পেয়ারা পরিপক্ক হয় না। জমি ভালো হলে হেক্টর প্রতি ১২ থেকে ১৪ মেট্রিক টন পেয়ারার উৎপাদন হয়।
বাউকাঠির চাষী হরিপদ জানান, প্রতি বছর এমন সময় পাইকাররা গাছ থেকে পেয়ারা পাড়ার প্রস্তুতি নিত। এবছর তাদের কোন তৎপরতা দেখিনা। তাই দুশ্চিন্তায় আছি আমরা। পাইকাররা বাগানের পেয়ারা না নিলে অর্ধেক পরিমান টাকা ফেরত দিতে হবে।
কীর্তিপাশার পেয়ারা চাষী অমল কৃষ্ণ বলেন, সামনে পেয়ারা বিক্রির মৌসুম। কিন্তু এবার সড়ক পথ বন্ধ থাকায় পাইকাররা দুঃশ্চিন্তায় আছে। তবে আমরা যারা বাগান বিক্রি করিনি একটু বাড়তি দামের আশায় তারা আরো বেশি চিন্তায় আছি। কারন পাইকাররা না কিনলে কাদের কাছে বিক্রি করব। প্রতি বছর এই ভাসমান বাজারে কোটি কোটি টাকার কেনা-বেঁচা হয়।
হিমানন্দকাঠি এলাকার পাইকার সোবাহান মৃধা জানালেন এবার করোনার কারনে আমরা বাগান কিনে বেকায়দায় পরেছি। কারন কিছু দিন পরেই পেয়ারা বিক্রি শুরু হবে। সড়ক পথ বন্ধ থাকায় এসব পেয়ারা কিভাবে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠাব তাই ভাবছি। এবার লাখ লাখ টাকার লোকসান গুনতে হবে আমার মত পাইকারদের।
ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক মোঃ জোহর আলী জানালেন, পেয়ারা চাষিদের প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হবে। সেই সাথে পেয়ারা চাষিসহ পর্যটন কেন্দ্রিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিংবা উদ্যোক্তাদের জন্য এসএমই ঋণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।