আন্তর্জাতিক ডেস্ক
তিনমাস বয়সি তৈয়বুল্লাহ। ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। পাশে থাকা মা বারবার মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে দেখছেন ছেলে শ্বাস নিচ্ছে কি-না। ছেলের নেতিয়ে যাওয়া দেখে কেঁদে উঠেন অসহায় মা। আফগানিস্তানের এই হাসপাতালে একটিও কার্যকর ভেন্টিলেটর নেই।
বাচ্চাদের নাকের কাছে অক্সিজেন টিউব ধরে রাখতে হয় মাদের। কারণ তাদের মুখের সাইজের মাস্ক হাসপাতালে পাওয়া যায় না। আবার যেসব কাজ হাসপাতাল কর্মীদের করার কথা তা করছেন শিশুদের অভিভাবকরাই।
এরমধ্যেই আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ঘোরের এই শিশু হাসপাতালে তৈয়বুল্লাহকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন চিকিৎসকরা। ডাক্তার আহমাদ সামাদি এসে তৈয়বুল্লাহর বুকে একটা স্টেথোস্কোপ রাখেন। কিন্তু তিনি স্পষ্ট হৃদস্পন্দন শুনতে পাননি।
এরপর অক্সিজেন পাম্প নিয়ে ছুটে আসেন নার্স এডিমা সুলতানি। তৈয়বুল্লাহর মুখের ওপর রেখে বাতাস দেয়ার চেষ্টা করেন। ডাক্তার সামাদি তার বুড়ো আঙুল ব্যবহার করে ছেলেটির ছোট্ট বুকে চাপ দেন। কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। মারা যায় ছোট্ট তৈয়বুল্লাহ। কান্নায় ভেঙে পড়েন মা নিগার।
এরপর তার শিশুপুত্রকে কম্বলে মুড়িয়ে দাদা গাওসাদ্দিনের হাতে তুলে দেয়া হয়। সদ্যমৃত শিশুকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হয় পরিবার। তৈয়বুল্লাহর মৃত্যুতে দাদা গাওসাদ্দিন যেন হতবাক হয়ে গেছেন। তিনি জানান, তার নাতি নিউমোনিয়া ও অপুষ্টিতে ভুগছিল। কিন্তু জেলা চরসাদ্দা থেকে তাকে এখানে আনতেই আট ঘণ্টা লেগেছে।
আফগানিস্তানের হাসপাতালগুলোতে এ দৃশ্য নতুন নয়, বরং নিত্যদিনের। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্যমতে, আফগানিস্তানে প্রতিদিন প্রতিরোধযোগ্য রোগে ১৬৭ জন শিশু মারা যায়। কিন্তু উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে এই শিশুরা নতুন জীবন পেতে পারত।
বিবিসি বলছে, এই সংখ্যা শুধুমাত্র অনুমান। কেউ যদি আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় ঘোর প্রদেশের বড় হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক বা শিশুরোগ ওয়ার্ড পরিদর্শন করে, তাহলে প্রকৃত পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারবে।
হাসপাতালের একাধিক কক্ষ অসুস্থ শিশুতে পূর্ণ। প্রতিটি বিছানায় কমপক্ষে দুজন শিশু নিউমোনিয়ার সঙ্গে যু্দ্ধ করছে। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এই বিপুল সংখ্যক শিশুকে দেখাশোনার জন্য রয়েছে মাত্র ২ জন নার্স।
পাশের আরেকটি কক্ষে আরও দুজন শিশু রয়েছে যাদের ক্রিটিক্যাল কেয়ারে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করা উচিত। কিন্ত এই হাসপাতালে তা অসম্ভব। কিন্তু এত ঘাটতি থাকার পরও এটিই ঘোর প্রদেশে বসবাসকারী কয়েক লাখ অধিবাসীর জন্য ‘সেরা’ হাসপাতাল।
আফগানিস্তানে জনস্বাস্থ্য খাত কখনওই দেশটির জনগণের জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। খাতটির উন্নয়নের জন্য বিদেশি যেসব সহায়তা এসেছে ২০২১ সালের পর; যা তালেবানদের হাতে চলে গেছে। গত দেড় বছরে স্বাস্থ্যখাতের কোনো উন্নয়ন তারা করেনি। দেশটির বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিদর্শন করে দেখা গেছে, সবগুলোরই কাঠামো ভেঙে গেছে।
তৈয়বুল্লাহর এভাবে মরার কথা না। কারণ তার প্রতিটি রোগ নিরাময়যোগ্য। নার্স সুলতানি বলেন, ‘আমিও একজন মা। যখন এভাবে চোখের সামনে আমি কোনো শিশুটিকে মরে যেতে দেখি, তখন আমার মনে হয় যেন আমি আমার নিজের সন্তানকে হারিয়েছি। যখন আমি তার মাকে কাঁদতে দেখি, তখন আমার হৃদয় ভেঙে যায়। এটা আমার বিবেকে আঘাত করে।’
এই নার্স আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে যন্ত্রপাতি নেই। নেই প্রশিক্ষিত কর্মী। বিশেষ করে নারী কর্মীদের অভাব রয়েছে। যখন আমাদের একসঙ্গে অনেক গুরুতর রোগীকে দেখাশোনা করতে হয়, তখন কাকে রেখে কাকে দেখব? আর তাই চোখের সামনেই শিশুরা মারা যায়। দেখা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকে না।’