জাতীয় ডেস্ক:
ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী প্রান্ত মিত্র (২৩) হত্যাকাণ্ডে জড়িত ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বিভিন্ন আলামত।
গ্রেফতার হওয়া চারজন হলেন- ফরিদপুর শহরের গুহলক্ষীপুর এলাকার শাহীন শেখের ছেলে সজীব শেখ (২৩) ও একই এলাকার আ. সামাদ শেখের ছেলে মাসুম শেখ (৩৪), জেলা সদরের মমিনখাঁর হাট এলাকার আবু তালেব মল্লিকের ছেলে ইস্রাফিল মল্লিক (৩৪) ও জেলা শহরের টেপাখোলা এলাকার লিটন ব্যাপারীর ছেলে সিফাতুল্লাহ বেপারী (১৯)।
তাদের কাছ থকে হত্যাকাণ্ডের সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, চাপাতি, সেভেন গিয়ার চাকু ও রেঞ্জসহ হত্যাকাণ্ডের সময় হত্যাকারীর গায়ে থাকা রক্তমাখা জামা-কাপড়, জুতা ও বেল্ট উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে সজীব, ইস্রাফিল ও সিফাতুল্লাহ ছিনতাই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। আর মাসুম তাদের মোটরসাইকেল সরবরাহ করেন।
বুধবার (০২ আগস্ট) দুপুরে ফরিদপুরের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান।
পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান বলেন, গ্রেফতার হওয়া সবাই মাদকসেবী। জেলখানা থেকে তাদের একে অপরের সঙ্গে সখ্যতা ও সংঘবদ্ধতা তৈরি হয়। তারা মাদকসেবন ও যৌনপল্লীতে ফূর্তির জন্য টাকা জোগাড় করতে এসব ছিনতাই করতো।
তিনি বলেন, গত ২৪ জুলাই দিবাগত রাত দুই টার দিকে হৃদয় নামে এক বন্ধুর বোনের ডেলিভারি সংক্রান্ত জটিলতায় সহায়তা করতে প্রান্ত শহরের ওয়ারলেসপাড়ার বাসা হতে বের হন। এরপর একটি রিকশায় হাসপাতালে যাওয়ার পথে আলিমুজ্জামান ব্রিজের ঢালে তিন ছিনতাইকারী তার স্মার্ট ফোন ও দুই হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। এসময় ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে তার বুকে চাকু দিয়ে কোপ মেরে তাকে হত্যা করে তারা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে জানানো হয়, ছিনতাইকারীরা প্রান্তকে হত্যার পরে রাত পৌনে ৪টার দিকে আলীপুর বাদামতলী সড়কে একজন সবজি বিক্রেতার ভ্যান থামিয়ে ৩ হাজার টাকা ছিনতাই করে। রাত সোয়া ৪টার দিকে ঝিলটুলীতে পুরাতন পাসপোর্ট অফিসের সামনে ধুলদি মসজিদের ইমাম মুফতি আবু নাসিরের কাছ থেকে চাপাতির ভয় দেখিয়ে একটি স্মার্ট ফোন ও নগদ টাকা ছিনতাই করে।
ভোর ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে শহরের কমলাপুরে জেলা জাকের পার্টির সভাপতি মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে কুপিয়ে জখম করে তার কাছ থেকে স্মার্ট ফোন ও নগদ টাকা ছিনতাই করে। তারপর ভোর ৫টার পরে তারা পূর্ব খাবাসপুর অন্ধকল্যাণ হাসপাতালের সামনে শরীফ উল্লাহ মাহমুদ মিয়া নামে একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ, একটি স্মার্ট ফোন ও নগদ টাকা ছিনতাই করে।
পরবর্তীতে সদর উপজেলার কানাইপুরে গিয়ে ছিনতাইয়ের টাকা ভাগাভাগি করে নেন। ইস্রাফিল নেন ৮ হাজার টাকা, সজিবকে ৭ হাজার, সিফাত নেন ৪ হাজার টাকা। এছাড়া মোটরসাইকেল দেয়ার জন্য মাসুমকে কিছু টাকা দেয়া হয়। এরপর সেখান থেকে তারা লাপাত্তা হয়ে যায়।
প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়, এ গণছিনতাইয়ের অভিযোগ পেয়ে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকতা, থানা পুলিশ ও ডিবির সমন্বয়ে পুলিশের একটি চৌকস টিম গঠন করে মামলার তদন্ত পরিচালনা করা হয়। প্রথমে প্রান্ত যে রিকশায় যাচ্ছিল সেই রিকশা চালককে শনাক্ত করা হয়। তারপর তার ভাষ্যমতে, বিভিন্ন সিসি টিভি ফুটেজ পর্যালোচনা ও তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় মঙ্গলবার (১ আগস্ট) সন্ধ্যায় ঢাকার শ্যামপুর থেকে সজিব শেখকে গ্রেফতার করা হলে তার কাছ থেকে নিহত প্রান্ত মিত্রের ছিনতাই হওয়া মোবাইল সেট উদ্ধার করা হয়।
এরপর তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী মধুখালী থেকে আরেক আসামি ইস্রাফিল মোল্লাকে গ্রেফতার করার পর তার কাছ থেকে যাদু মিয়ার ছিনতাই হওয়া মোবাইল সেট উদ্ধার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী পরবর্তীতে অন্যান্য মালামাল উদ্ধার করা হয়।
পরে আসামিদের স্বীকারোক্তি ও তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একইদিন রাত দেড়টার দিকে কানাইপুরের বাসিন্দা রাজীবের পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত একটি সেডান গিয়ার ছুরি, একটি চাপাতি ছুরি উদ্ধার করা হয়।
ইস্রাফিলের দেয়া তথ্যমতে, আসামি সিফাতকে কোতোয়ালি থানাধীন টেপাখোলা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং তার হেফাজত থেকে সজীবের রক্তমাখা শার্ট ও এক জোড়া স্যান্ডেল উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতারকৃত আসামিদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, একইদিন ভোর রাত সাড়ে ০৪টার দিকে অভিযুক্ত মাসুমকে শহরের ভাজনডাঙ্গা টিবি হাসপাতাল মোড় এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং তার হেফাজত থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি ডিসকভার মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, সজিব শেখের নামে ৬টি, ইস্রাফিলের নামে ৯টি, সিফাতের নামে ২টি ও মাসুমের নামে ২টি মামলা রয়েছে।
প্রেস ব্রিফিং শেষে নিহত প্রান্তের মা পুতুল মিত্র সাংবাদিকদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে বলেন, ‘আমিতো টিকতে পারতেছি না। আমার বাবা সারাজীবন পরের উপকার করতে করতে নিজের জীবন দিয়ে গেল। এমনভাবে আর কারো জীবন যেন না যায়। কোনো মায়ের বুক এভাবে খালি যেন না হয়। আমি দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।’
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের কর্মকতা, নিহত প্রান্তর বাবা বিকাশ মিত্র ও মা পুতুল মিত্রসহ সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে ২৭ জুলাই রাতে প্রান্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় নিহত প্রান্তর বাবা বিকাশ মিত্র বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে হত্যা ও ছিনতাইয়ের মামলা দায়ের করেন।