হোম জাতীয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিষমুক্ত আম নামবে কবে, জানা গেল

জাতীয় ডেস্ক:

গাছে গাছে থাকা ফজলী, ক্ষিরসাপাত, ল্যাংড়া, আশ্বিনাসহ বিভিন্ন জাতের আমে পরানো হচ্ছে ফ্রুট ব্যাগ। পরিপক্ব হলে গাছ থেকে আম পাড়ার পর বাজারজাত করার আগে খোলা হবে এসব ব্যাগ। এরমধ্যে দীর্ঘ এই সময়ে ব্যাগের মধ্যেই আবৃত থাকবে সুমিষ্ট আম। আমে স্পর্শ করবে না কোনোধরনের কীটনাশক ও বালাইনাশক।

আমের ওজন ১০০-১৫০ গ্রাম হলেই বেঁধে দেয়া হয় এসব ফ্রুট ব্যাগ। এরপর আম পাকা পর্যন্ত ব্যাগবন্দি থাকে আম। সম্পূর্ণ বিষমুক্ত নিরাপদ আম উৎপাদন হয় এই পদ্ধতিতে।

বর্তমান সময়ে নিরাপদ আম উৎপাদনের প্রতিযোগিতা চলছে দেশব্যাপী। নিরাপদ আম উৎপাদন ছাড়াও আমের বাহ্যিক সৌন্দর্য বাড়ানো, কৃষকদের কীটনাশক প্রয়োগ বাবদ খরচ কমানো ও বিদেশে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের লক্ষ্যে আমের রাজধানীখ্যাত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতিবছর বাড়ছে ফ্রুট ব্যাগিংয়ের ব্যবহার। শতভাগ নিরাপদ আম উৎপাদনের উপায় হওয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ফ্রুট ব্যাগিং।

ফ্রুট ব্যাগিং করার সাধারণত এক মাসের মধ্যেই এই বিষমুক্ত আম পাড়া হয় বলে জানিয়েছেন আমচাষিরা। জেলায় এবছর রেকর্ড পরিমাণ প্রায় ২২ কোটির অধিক আমে ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

এদিকে, ফ্রুট ব্যাগিংয়ের ওপর আরোপ করা সরকারি ভ্যাট মওকুফের দাবি জানিয়েছেন বাগান মালিকরা। কৃষিপণ্য ঘোষণা করে আমদানিনির্ভর ফ্রুট ব্যাগিংয়ে সরকারি ভুর্তকি ও বাজার মনিটরিংয়ের দাবি কৃষকদের।

পোকা-মাকড় দমনে কীটনাশকের মাধ্যমে পরিচর্যার বিকল্প হিসেবে দেশের বাজারে এ পদ্ধতির আম চাহিদা থাকায় বিক্রি বাড়ে। আমদানি করা ব্যাগের প্রায় পুরোটাই আসে বিদেশ থেকে। অভিযোগ রয়েছে, আমচাষিদের চাহিদাকে পুঁজি করে নিম্নমানের ফ্রুট ব্যাগ বাজারজাত করে সাধারণ কৃষকদের ঠকায় মধ্যস্বত্বভোগীরা। তাই কৃষকদের দাবি, ফ্রুট ব্যাগ ও তার কাঁচামালকে প্রকৃত কৃষিজাত পণ্য হিসেবে ঘোষণা করে অধিক হারে বাজার মনিটরিং করার। এতে একদিকে যেমন নিরাপদ আম উৎপাদন নিশ্চিত সম্ভব হবে, তেমনি অন্যদিকে লাভবান হবে আমচাষি, ব্যবসায়ী ও রফতানিকারকরা। বর্তমানে ফ্রুট ব্যাগ কৃষিপণ্য ঘোষণা না হওয়ায় তার বাজার মনিটরিং করতে পারছে না কৃষি বিভাগ।

শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিডেটের সাধারণ সম্পাদক ও আম রফতানিকারক ইসমাঈল খান শামিম জানান, ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত আম বিদেশে রপ্তানিযোগ্য ও শতভাগ নিরাপদ। কিন্তু অনেক সময় বাজারে থাকা মানহীন ব্যাগের কারণে তা সম্ভব হয় না। আমের ওজন ১০০ গ্রাম হলেই আমে ব্যাগ পরানো হয়। এতে করে কৃষক অন্তত ১০-১২ বার কীটনাশক প্রয়োগের হাত থেকে রক্ষা পায়। এছাড়াও ব্যাগিং করা আম আকর্ষণীয়, দাগহীন ও পুরোপুরি কীটনাশকমুক্ত হয়। তাই আমচাষি, ব্যবসায়ী, রফতানিকারক ও ভোক্তার স্বার্থে ফ্রুট ব্যাগিংকে কৃষি পণ্য ঘোষণা করার দাবি জানান তিনি।

সম্প্রতি আমে ফ্রুট ব্যাগিং করেছেন বাগান মালিক সোহান শাহরিয়ার। সময় সংবাদকে তিনি বলেন, গতবছর ১০ বিঘার একটি বাগান নিয়েছি। ফজলি, আশ্বিনা, ল্যাংড়া, খিরসাপাত জাতের আম রয়েছে। এসব আমে গত ১৫ দিন আগে ফ্রুট ব্যাগিং সম্পন্ন করছি। এতে আমে কোন দাগ থাকে না, বিষ দিতে হয় না, আমের কালারও খুব ভালো আসে।

ফ্রুট ব্যাগিংয়ের শ্রমিক আব্দুল মতিন বলেন, ‘আমের সাইজ গুটি থেকে একটু মাঝারি হলেই বাগান মালিকরা ব্যাগিং করা শুরু করে। গত টানা ৭ দিন বিভিন্ন বাগানে ফ্রুট ব্যাগিং করেছি। গত ২-৩ বছর আগেও এতো বেশি গাছে ব্যাগিং হতো না। তবে এবছর প্রচুর পরিমাণে আমের ব্যাগিং হয়েছে। ছোট, মাঝারি, বড় সাইজের সিংহভাগ গাছেই ব্যাগিং করে অধিক লাভবান হচ্ছেন আমচাষিরা।’

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও রাশিয়ায় আম রপ্তানিকারক শিবগঞ্জ ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবীব সময় সংবাদকে বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ফ্রুট ব্যাগিংয়ের সিংহভাগই হয় আশ্বিনা জাতের আমে। এই জাতের আমে যদি ফ্রুট ব্যাগিং না করা হয়, তাহলে অর্ধেক আমই গাছেই পোকায় নষ্ট হয়ে যায়। তবে এখন প্রায় সব জাতের আমেই ব্যাগিং করা হচ্ছে। ফ্রুট ব্যাগিং করা হলেই আম পাড়া পর্যন্ত নিশ্চিত হয়ে থাকা যায়। এমনকি আমে কোনোপ্রকার কীটনাশকও প্রয়োগ করতে হয় না। ফলে উৎপাদন খরচও কমে যায়। এমনকি দামও বেশি পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময়ে আমরা বিভিন্ন মহলে ফ্রুট ব্যাগকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি করলেও এর কোন ফলাফল মেলেনি। যা খুবই দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন তিনি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ব (আম) গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোশাররফ হোসেন জানান, আমের ওজন ৬০-১০০ গ্রাম হলে ফ্রুট ব্যাগ করার উপযুক্ত সময়। এতে ব্যাগিং করা আমটি অধিক পরিমানে হলুদ রং ধারণ করে। তবে আম ফ্রেস রাখতে চাইলে ৫০ গ্রাম ওজনের সময় ফ্রুট ব্যাগিং করতে হবে। কৃষক ভাইয়েরা সাধারণ রোগবালাই-ছত্রাক দমন করতে ১২-১৫ কীটনাশক-ছত্রাকনাশক ব্যবহার করে। কিন্তু ফ্রুট ব্যাগিং করার ফলে আর কোন কীটনাশক-ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে না এবং খরচও অনেক কমে যাবে। এমনকি আমগুলো পাকার পরে পেড়ে কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক ছাড়াই সংরক্ষণ করা যাবে ৯ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত।

এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরও জানান, আম পরিপক্ক হওয়ার আগে-পরে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হয়। এতে আমের গায়ে ছত্রাক দেখা দেয়। ফ্রুট ব্যাগিং করলে তা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিশেষ ধরনের কাগজের এই ব্যাগে দুটি আস্তরণ রয়েছে। বাইরের আস্তরণটি বাদামি রঙের, আর ভেতরেরটি কালো রঙের।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. পলাশ সরকার সময় সংবাদকে বলেন, ফ্রুট ব্যাগিংয়ের ফলে আমের বাহ্যিক রং খুব আকর্ষণীয় হয়। এতে ক্রেতারা আকৃষ্ট হয়। এছাড়াও শতভাগ নিরাপদ আম উৎপাদন নিশ্চিত হয়।

অন্যদিকে, বিদেশে আম রপ্তানিতে প্রধান শর্ত হওয়ায় ফ্রুট ব্যাগিংয়ের ব্যবহার বাড়ছে। কৃষি বিভাগ নিরাপদ আম উৎপাদন ও বিদেশে আম রপ্তানি বাড়াতে ফ্রুট ব্যাগিংয়ের ব্যবহার নিশ্চিত করতে কৃষকদের পরামর্শ, প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। গত কয়েক বছরের চেয়ে চেষ্টায় জেলায় এবছর প্রায় ২২ কোটি আমে ফ্রুট ব্যাগ ব্যবহার করেছে কৃষকরা।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর জমিতে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন। এবছর প্রায় ২২ কোটি আমে ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়েছে। গতবছর ১৬ কোটি ৩ লাখ, ২০২২ সালে ১০ কোটি ৩৮ লাখ, ২০২১ সালে ১০ কোটি ১২ লাখ ও ২০২০ সালে জেলায় সাড়ে ৭ কোটি আমে ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন