হোম জাতীয় ঘুষের শিক্ষক পড়াবেন কী?

জাতীয় ডেস্ক :

এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগে এখন টাকার ছড়াছড়ি। আর সেটা লাখ লাখ টাকা। টাকা ছাড়া শিক্ষক হওয়া যায় না। টাকা ছাড়া এমপিওভুক্ত হওয়া যায় না। প্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্ত হয় না। বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি সবখানে টাকা। শুধু শিক্ষাটাই নাই।

টিআইবি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজে অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পেতে সাড়ে তিন থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ লাগে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন, শিক্ষক ও স্কুলের এমপিওভুক্তি সবখানেই টাকার খেলা। তারা এর একটি সার্বিক হিসাবও দিয়েছে। সেই হিসাব দেখে আপনি শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাস্তব অবস্থা বুঝতে পারবেন।

তাদের হিসাব মতে, অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পেতে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে ১৫ লাখ টাকা, সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দিতে পঞ্চাশ হাজার থেকে তিন লাখ, সহকারী গ্রন্থাগারিক পদে নিয়োগ পেতে দুই থেকে তিন লাখ, শিক্ষক এপিওভুক্তি পাঁচ হাজার থেকে এক লাখ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নীরিক্ষা পঞ্চাশ হাজার থেকে পাঁচ লাখ, পাঠদান অনুমোদন এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ, স্বীকৃতি নবায়ন পাঁচ হাজার থেকে ৩০ হাজার এবং শিক্ষক বদলি এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়।

সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দেওয়ার বিষয়টি একটু খোলাসা করা দরকার। জাতীয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ নিয়োগ অনুমোদন দিলেই সহজে সহকারী শিক্ষকরা যোগ দিতে পারেন না। যোগ দিতেও ঘুষ দিতে হয়। আর প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং অধ্যক্ষ নিয়োগ তো সরাসরি ম্যানেজিং কমিটি ও মাউশির হাতে। তাই ঘুষের মচ্ছব এখানে বেশি।

এবার আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি, কমপক্ষে ১০ বছর আগের। স্বাস্থ্যের ড্রাইভার মালেকের কোটি কোটি টাকা নিয়ে এখন যেমন হইচই হচ্ছে, তেমনি একটি ঘটনা। আমি শিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের(মাউশি)মহাপরিচালকের একজন ড্রাইভারকে খুঁজে পেয়েছিলাম, যিনি কোটি কোটি টাকার মালিক। ওই ঘটনার অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে তার ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট, উত্তরায় ৫ কাঠার প্লট, পরিবারের ব্যবহারের জন্য গাড়ি খুঁজে পেয়েছিলাম। তিনি ধানমন্ডিতে যে ফ্ল্যাটে থাকতেন সেই অ্যাপার্টমেন্ট মালিক সমিতির সেক্রেটারি ছিলেন তিনি। আর সবাই জানতেন তিনি বড় ব্যবসায়ী।

তার ব্যাপারে আরও খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারি মাউশির টেবিল চেয়ারও ঘুষ খায়। গ্রাম থেকে আসা শিক্ষকদের কাছ পিওনও স্যার! তাদের কিছু না দিয়ে ভবনেই তারা ঢুকতে পারতেন না। আর ওই যে ড্রাইভারের কথা বললাম, তিনি মূলত সরাসরি মহাপরিচালকের হয়ে মক্কেলদের সাথে দেনদরবার করে টাকার পরিমাণ ঠিক করতেন। তা থেকে তিনি যা পেতেন তাতেই তার এত!

এ দুর্নীতি কারা করে? এর সঙ্গে কারা জড়িত। টিআইবি তারও জবাব দিয়েছে। তারা হলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরর কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ম্যানেজিং কমিটি, রাজনৈতিক নেতা এবং প্রধান শিক্ষক।

এ দুর্নীতির শুরুটা স্কুল-কলেজ থেকে। প্রথমত নিজের আত্মীয়-স্বজনকে চাকরি দিতে বাড়ির পাশে একখণ্ড জমি দিয়ে তাতে ঘর তুলে স্কুল কলেজ চালু হয়। তারপর নিবন্ধন, প্রতিষ্ঠানের এমপিও, শিক্ষকদের এমপিও করানো হয় টাকার বিনিময়ে। এখানে টাকা ঢালতে পারলেই আর মান বা যোগ্যতার প্রশ্ন থাকে না। এটাতো গেল এক দিক। এমপি এবং ইউএনও সাহেব মিলে শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ নিয়োগ দেন। এখানে চলে টাকার খেলা। টাকা দিতে পারলে নিয়োগ কনফার্ম। যোগ্যতা কোনো বিষয় নয়। আর আত্মীয়-স্বজনের পুনর্বাসন তো আছেই। কেউ বলতে পারেন এখনতো শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা হয়। তা সত্য। কিন্তু সবার জন্য তো আর চাকরি নেই। কাকে নেওয়া হবে তাতো ম্যানেজিং কমিটি এবং মাউশির হাতে। তাই ঘুষ লাগেই। আর এটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক ঘুষ সিস্টেমে চলে।

প্রতিষ্ঠানগুলোর ম্যানেজিং কমিটির প্রধান হলেন পদাধিকার বলে স্থানীয় সংসদ সদস্য। যদিও এখন আইন করে সর্বোচ্চ তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারেন এমপি সাহেব। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। কারণ এমপি সাহেবের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কারো পক্ষে প্রধান হওয়া সম্ভব নয়। শোনা যাচ্ছে, এখানেও অর্থের লেনদেন আছে। কোটার বাইরে আর সদস্যরা ভোটে নির্বাচিত হন। সেই ভোটের পোস্টার এবং প্রচারের বাহার দেখলে সহজেই বোঝা যায় এটা আয়ের একটা বিশাল উৎস। তা না হলে নির্বাচিত হতে এত টাকা খরচ করবেন কেন?

হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হতে হলে কমপক্ষে ডিগ্রি পাস হতে হবে। কিন্তু এই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। ফলে যাদের ক্ষমতা আছে, টাকা আছে, যোগাযোগ আছে তারাই ম্যানেজিং কমিটিতে থাকেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা থাক আর না থাক। তারা টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ দেবেন না তো কারা দেবেন! আর তাদের নিয়োগকৃত শিক্ষকরা তাদেরই অনুগামী হবেন। পড়াশোনার কাজে তারা মনোনিবেশ কেন করবেন। আর যেভাবে নিয়োগ পান তাতে সেই যোগ্যতা তাদের থাকার কথা নয়।

জাতীয় শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে শিক্ষার মানকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই আমার প্রশ্ন, এই ধরনের ঘুষের শিক্ষক আর প্রতিষ্ঠান দিয়ে শিক্ষার মান উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব। এতে একটি পক্ষের আর্থিক উন্নয়ন হতে পরে, মান উন্নয়ন অবশ্যই নয়।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন