আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
সৌদি সিংহাসনের উত্তরসূরি মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে দেখা করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। সম্পর্কোন্নয়নে বৃহস্পতিবার (২৮ এপ্রিল) জেদ্দা শহরে দুই নেতার মধ্যে বৈঠক হয়েছে। সেখানে এরদোগানের সৌজন্যে নৈশভোজেরও আয়োজন করা হয়েছে।
২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে ওয়াশিংটনে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার পর এই প্রথম সৌদি সফরে গেলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট। বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলা এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দেয়।-খবর আলজাজিরার
সৌদির রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা এসপিএ-এর প্রকাশ করা ছবিতে দেখা গেছে, পশ্চিমা বিশ্বে এমবিএস নামে পরিচিত যুবরাজকে আলিঙ্গন করেছেন তুর্কি নেতা। যদিও খাসোগি হত্যার ষড়যন্ত্রে অনুমোদন দিয়েছেন বলে যুবরাজকে সরাসরি দায়ী করেছেন মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিককে হত্যায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে সৌদি আরব।
আংকারার সঙ্গে রিয়াদের আগের শীতল সম্পর্কের অবসান হয়েছে বলেই আভাস দিচ্ছে যুবরাজ ও এরদোগানের উষ্ণ আলিঙ্গন। তারা দু’দেশের সম্পর্ককে নতুন করে পর্যালোচনা করে তা উন্নয়নে জোর দেবেন বলে দাবি করা হয়েছে।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের ছবিতে দেখা যায়, যুবরাজের বাবা বাদশাহ সালমানের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন এরদোগান। এছাড়া মসজিদুল হারামে গিয়ে একদল ওমরাযাত্রীর নেতৃত্ব দেন তিনি।
এমন এক সময়ে এই সফরের আয়োজন, যখন মুদ্রার দরপতন ও মুদ্রাস্ফীতির কারণে ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি তুরস্ক। এই কঠিন সময়ে জ্বালানি-সমৃদ্ধ দেশগুলোর কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করছে এরদোগান সরকার।
ইস্তাম্বুল থেকে সৌদি শহর জেদ্দায় উড়াল দেওয়ার আগে এরদোগান বলেন, আমি আশা করছি, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন যুগ শুরু হয়েছে। প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতা বাড়ানো হবে।
তিনি যখন জেদ্দায় যান, তখন শহরটির সড়কগুলোর দুই পাশে সৌদি ও তুর্কি পতাকা উড়ছিল।
২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে খাসোগিকে হত্যার পর তার অঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে রাসায়নিক উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তার মরদেহের হাল কী হয়েছিল, এখন পর্যন্ত সেই তথ্য পাওয়া যায়নি।
এই বিভৎস হত্যাকাণ্ডে সৌদি একঘরে হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়ে যায়। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে কোণঠাসা হয়ে পড়েন মোহাম্মদ বিন সালমান। আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী আংকারার সঙ্গেও উত্তেজনা বেড়ে যায়।
ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্টের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একটি স্বাধীন তদন্ত শুরু করে তুরস্ক। এরদোগান তখন বলেন, সৌদি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এই হত্যার নির্দেশ এসেছে।
বিপরীতে বেসরকারিভাবে পণ্য বর্জন করে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে রাখার চেষ্টা করে সৌদি আরব। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে বাণিজ্য বেড়ে যায়। গত জানুয়ারিতে সৌদি সফরের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন এরদোগান।
চলতি মাসের শুরুতে খাসোগি হত্যায় সন্দেহভাজন ২৬ সৌদির অনুপস্থিত বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত করে ইস্তাম্বুল আদালত। মামলার কাগজপত্র সৌদি আরবের কাছে হস্তান্তর করেন তারা।
এতে খাসোগির বাগদত্তা খাদিজা সেনজিসসহ মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা উচ্চ আদালতে আপিলের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন।
এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক পরিসরে সৌদি আরবের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। সৌদির রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী শিহাবি বলেন, এরদোগানের সফর উপসাগরীয় দেশটির কর্মকর্তাদের জন্য বড় বিজয়। তারা এখন সবকিছু নতুন করে শুরু করতে চান।
তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে হত্যার দায় থেকে যুবরাজ রেহাই পেয়ে যাবেন। এরদোগানও কোণঠাসা ছিলেন। অর্থনৈতিক ও পর্যটন বর্জনের কারণে তুরস্কের অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। যে কারণে তাকে সৌদিতে যেতে হয়েছে। এতে দু’দেশের লাভ হয়েছে।
আলী শিহাবি বলেন, এরদোগানের দরকার সৌদির সঙ্গে পর্যটন ও বাণিজ্যকে চাঙ্গা করা। আর আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে সৌদিও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায় করে নেবে। সম্ভবত তুরস্কের সঙ্গে সৌদির একটি অস্ত্র চুক্তি হতে পারে।
সফরের আগে এরদোগান বলেন, তিনি মনে করেন, সৌদির সঙ্গে তুরস্কের স্বাস্থ্য, জ্বালানি, খাদ্য নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা শিল্প ও অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। এতে দু’দেশেরই স্বার্থ রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক উপদেষ্টা দিনা ইসফান্দিয়ারি বলেন, এরদোগানের এই সফরের বড় চালিকাশক্তি হচ্ছে অর্থনৈতিক স্বার্থ। মনে হচ্ছে, তুরস্ক খাসোগির কথা ভুলে গেছে। সৌদির চাওয়াও এমনটি।
তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত যে, সম্পর্কোন্নয়নে দু’পক্ষের কাছ থেকে একটি বিবৃতি আসবে। তারা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে চুক্তি করবেন। সৌদিদের কল্যাণে তুরস্কের অর্থনীতিও নতুন গতি পাবে।
তুরস্কের বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া কয়েক দফা বিক্ষোভে এরদোগানের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। অথচ সামনের বছরে তুরস্কে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এক্ষেত্রে উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছ থেকে সমর্থন চাচ্ছেন এরদোগান।
আরব বসন্তের পর থেকে এসব দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। এর আগে গেল ফেব্রুয়ারিতে প্রায় এক দশকের মধ্যে প্রথম সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন তিনি। তখন তুরস্কে বিনিয়োগ করতে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এর আগে ২০১৭ সালে সৌদি সফর করেন এরদোগান। তখন কাতারের সঙ্গে উপসাগরীয় দেশগুলোর বিতর্কের মীমাংসার চেষ্টা করেন তিনি।
গেল কয়েক মাস ধরেই বৈরিতা দূর করতে চেষ্টা করে আসছিল দু’দেশ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন শপথ নেওয়ার পর থেকেই এই পদক্ষেপ শুরু হয়েছে। আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে নিজেদের মতভেদগুলো দূর করতে তারা জোর দেন।