মোস্তফা কামাল, নড়াইল অফিস:
নড়াইলের বড়দিয়া খাদ্যগুদামের কর্মকর্তা (ওসিএলএসডি) পলাশ মন্ডল। সরকারী মূল্যে ধান সংগ্রহে টনপ্রতি ঘুষ নেন ১হাজার টাকা। টাকা না দিলে ধান ফেরত নেয়া হয়,আর টাকা দিলে মানহীন ধানও গুদামে ঢোকে। এসব নিয়ন্ত্রন করেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও কয়েকজন দালাল। কয়েকজন স্থানীয় কৃষক শরীফুলের মাধ্যমে গুদামে ধান দিয়ে ঘুষের টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে শরীফুলের সাথে গুদাম কর্মকর্তার দূরত্ব তৈরী হয়। গোপনে গুদাম কর্মকর্তার কথা ভিডিও ধারন করে গুদাম কর্মকর্তাকে ফাসিয়ে দেন তিনি।
কিছুদিন আগে তোলা ভিডিওতে দেখা যায় গুদাম কর্মকর্র্তা লিটন মন্ডল তার কক্ষে বসে দালালদের সাথে ঘুষের টাকা পাবার জন্য নানা ধরনের হুমকী দিচ্ছেন। তিনি বলেন“আপনাদের টাকা আমি আলমারিতে তুলে রাখিনা,আমারে কেউ ছাড় দেয় না,গত বুধবারে ২২ হাজার টাকা দিয়ে এসেছি ডিসি ফুড(জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক) স্যারকে। আগের বৃহস্পতিবারে টিসি এফ(উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক) স্যার এখানে আসছিলো উনারে দিছি ১০ হাজার টাকা। টাকা না দিলে উনি সই করবেন না এটা ওটা বলতেছেন, উনারা তো কথা বলেন না উনারা কাজে দেখায়। এসময় কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,“চেয়ারম্যান সাহেব আর আপনারা সবাই থেকে এই সিদ্ধান্ত(টন প্রতি টাকা নেবার) নিলেন,এখন যদি ধান না দেয় তাহলেও আর কাজ চলে না,তাহলে আমি আমার মতো চলি।”
প্রতিবছরই ঘটা করে কৃষকের অ্যাপে লটারীর মাধ্যমে সরকারী মূল্যে ধান সংগ্রহের জন্য কৃষক নির্বাচন করা হয়। কৃষকেরা সরকারী মূল্যে ১ টন থেকে ৩ টন পর্যন্ত ধান গুদামে বিক্রি করতে পারেন। এ বছর কৃষকের কাছ থেকে প্রতিমন ধান ১২’শ টাকায় কেনা হবে ৭ মে থেকে শুরু হওয়া কার্যক্রম চলবে ৩১ আগষ্ট পর্যন্ত।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবছর জেলায় মোট ৪হাজার ২’শ ৪২ মে.টন ধান সংগ্রহ হবার কথা। এদিকে বড়দিয়া খাদ্য গুদামে সরকারী মূল্যে ৪’শ ১১ মে.টন ধান সংগ্রহের জন্য ১’শ ৩৭ জন কৃষক নির্বাচন করা হয়। ঘুষের কারনে এই গুদামে ৩ মাসে ধান সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ১’শ ৮৬ মে.টন।
তালিকায় নাম থাকা কয়েকজন কৃষক খাদ্যগুদামে ধান বিক্রি করতে গিয়ে ঘুষের টাকা চাওয়ায় তা দিতে না পেরে ফিরে এসছেন,আবার বহনের খরচ হিসেব করে অনেকেই বাধ্য হয়ে টনপ্রতি ১ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ধান বিক্রি করেছেন গুদামে।
এই ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে স্থানীয় কৃষকেরা।
জয়নগর ইউনিয়নের রামপুর গ্রামের কৃষক নাজির হোসেন বলেন, ‘বড়দিয়া খাদ্যগুদামে তিন টন ধান নিয়ে গেলে তিন হাজার টাকা দাবি করেন ওই কর্মকর্তা। আমি এক হাজার টাকা দিতে চাইলেও তিনি নেননি। বাধ্য হয়ে ধান ফিরিয়ে নিয়ে আসি।’
একই গ্রামের মুনছুর শেখ বলেন, ‘আমার কাছে তিন হাজার টাকা চেয়েছিলেন। কিন্তু এই ধান বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে গেলে তিন হাজারের বেশি টাকা খরচই হতো। তাই অনেক তোষামোদি করে আড়াই হাজার টাকায় মিটমাট করি।’ ওই গ্রামের ইমাম খান, আয়েদ আলী খানসহ আরও অনেকেই এমন অভিযোগ করেন। তারা বলেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান নিয়ে গেলে অথবা ঘুষ দিলে তবেই খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা ধান নিচ্ছেন গুদামে।
কালিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান খান শামীমুর রহমান নিজেও গুদাম কর্মকর্তার ঘুষ নেয়ার বিষয়টি জানেন। তিনি বলেন, ‘গুদাম আমার বাড়ির কাছেই। এলাকার কৃষকরা সেখানে ধান দিতে গেলে লিটন মন্ডল প্রতি কার্ডে দুই থেকে তিন হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। যারা ঘুষ দেন, তাদের ধান নেয়া স্থানীয় নড়াগাতি থানা আওয়ামীলীগের সদস্য থান ওয়েদ আলী বলেন,গুদাম কর্মকর্তা ঘুষ নিয়ে গরীব কৃষকের কাছ থেকে টাকা নেয়,তাহলে সরকারী নায্যমূল্য আর থাকলো কোথায়।
ঘুষের ভিডিও ধারনকারী কোটাকোল ইউপি চেয়ারম্যানের ভাই শরীফুল ইসলাম বলেন, বড়দিয়া খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা টাকা দিলে খারাপ ধানও নেয়। টাকা না ািদলে কোন কাজ হয় না।
এ সব বিষয়ে জানার জন্য বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই)বড়দিয়া খাদ্য গুদামে গেলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লিটন মন্ডল গুদাম থেকে আরেক সহযোগী কে নিয়ে বেরিয়ে যান। তার মুঠোফোনে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেন নি। চোখের সামনে দিয়ে ট্রাউজার পরিহিত অবস্থায় বেরিয়ে গেলেও গুদামের ভিতরে থাকা পরিবারের লোকজন জানায় উনি খুলনায় গেছেন।
গুদাম নিয়ন্ত্রনে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কথা বললেও কোটাকোল ইউপি চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে বলেন ,খাশিয়াল বা অন্য কোন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জড়িত থাকতে পারে। খাশিয়াল ইউপি চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ ধান ক্রয়ে তার সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেন।
নড়াইল জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিত্যানন্দ কুন্ডু ধান সংগ্রহে ঘুষে নিজের সংশ্লিষ্টার বিষয়ে বলেন,সে ভিডিও তে বুধবারে টাকা দেবার কথা বলেছে সেদিন আমি অফিসেই ছিলাম না। সে টাকা নিছে কিনা আমি জানিনা,তবে আমি কিম্বা আমার অফিস জড়িত নয়। এ বিষয়ে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দ্রুত তার বিরুদ্বে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।