হোম খুলনাযশোর কেশবপুরের গাছিরা রস আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন

কেশবপুরের গাছিরা রস আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 88 ভিউজ

ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি :

কেশবপুরের খেজুরগাছ কাটা গাছিরা রস আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। খেজুরের রসে অসাধারন উপকার আছে। শীতের আগমনে শুরু হয় গাছিদের ব্যস্ততা। সাথে সাথে কর্মকার ও কুমারদের ব্যস্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় যশোরের কেশবপুর উপজেলায় শীতের মৌসুম শুরু হতে না হতেই আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুরের রস আহরণে প্রতিটি গ্রামে গ্রামে গাছিরা গাছ প্রস্তুত শেষ করে রস আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। শীতকালে হাড়কাপানো ঠান্ডার মধ্যে রোদে বসে কাঁচা খেজুরের রস খেতে পছন্দ করেন অনেকে। শীত মৌসুমে গ্রামাঞ্চলে ঘরে ঘরে খেজুরের রসকে প্রক্রিয়াজাত করে হরেক রকমের পিঠা, পুলি, পায়েস, গুড় পাটালী, পেড়া ইত্যাদি তৈরী করে থাকেন। সারা বছর খেজুরের রস সংগ্রহ করা না গেলেও শীত কালের খেজুরের রস বেশি সুস্বাদু । শীত কমার সাথে সাথে রসও কমতে শুরু করে। শেষের দিকের রস এত মিষ্টি যে গাল ফিরিয়ে আনা যায়না। গাছ যখন শক্ত হয়, রস কমে যায়, ফলে গাছিরা কাটতে চাইনা। খেজুরের গুড়ে আয়রন ও লৌহ বেশি থাকে এবং হিমোগ্লোবিন তৈরীতে সাহায্য করে। খেজুরের রস খনিজ ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। খেজুর কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। বাংলাদেশে যে খেজুর হয় তাতে আঁশের ভাগ কম থাকায় অনেকে পছন্দ করেন না। তাই খেজুরের রসই প্রধান। শীত বাড়ার সাথে সাথে রসের চাহিদাও বাড়ে। আগে অনেক গাছিরা বাণিজ্যিকভাবে খেজুরের রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করতো। কিন্তু এখন বিভিন্নভাবে গাছ কমে যাচ্ছে। ফলে, এলাকায় গাছিরও অভাব হয়ে পড়েছে। এলাকায় কম বেশি হলেও ৫০০/৬০০ জন পেশাদার গাছির সন্ধান মেলে। তাতে খরিদ্দারদের পিঠা, পুলি, পায়েস খাওয়ার চাহিদা মেটাতে পারেন না।

গাছি মান্নান গাজী জানান, গাছ তুলতে দা, দড়া, ঠুঙ্গি, বালু, বালধারা সবসময় প্রস্তুত রাখতে হয়। ছোট অবস্থা থেকে গাছ থেকে রস পাড়া এবং আস্তে আস্তে গাছ কাটা শুরু করি তা প্রায় ২৫ বছর। অধিকাংশ গাছিরা গাছ কাটা ছেড়ে দিয়েছে। গাছির অভাবে খেঁজুর গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। শীত পড়ার সাথে সাথে আমাদের গাছ তোলার কাজ শুরু করতে হয়। রস সংগ্রহ করার যায়গা তৈরী করার জন্য প্রথম দিকে গাছের দিক নির্ণয় করে ডেগো পরিষ্কার করি। এর ১৫ দিন পর রস আসার জন্য গাছের মুখে চোখ কাটি, তাকে চাচ দেওয়া বলে । চাচের পাটালী অধিকাংশ লোকে পছন্দ করেন। প্রথম দিকে গাছ তুলতে খুব কষ্ট হয়। প্রতিদিন ১০/১২ টি করে গাছ তুলেছি। এবার আমি দুই পোন (১৬০) গাছ কাটা শুরু করেছি। এখনো চাচ দেওয়ার পর পালা করেছি।

মঙ্গলকোট গ্রামের গাছি জামাল উদ্দীন সরদার বলেন, এই গ্রামে রফিকুল ইসলাম, হেকমত আলী, পীর আলী, শাহিন, সিরাজুল ইসলাম-সহ এলাকায় বেশ কিছু গাছি আছে, খেজুর গাছ কমে গেলও কৃষকের জমির আইলে, রাস্তার পাশে, পতিত জমিতে খেজুর গাছ এখনও বেশ আছে। তাছাড়া সরকারী উদ্যোগে গাছ লাগানো হচ্ছে। সরকারীভাবে গাছিদের প্রশিক্ষণসহ সহযোগিতা পেলে মিষ্টির চাহিদা অনেকাংশ পুরণ হবে।

গাছি আফছার আলী জানান, তাল গাছ কাটার সময় হলে তালগাছ কাটি আর খেজুর গাছ কাটার সময় হলে খেজুর গাছ কাটি। আমি গাছ কাটতে কাটতে বুড়ো প্রায়। ১৫/১৬ টি গাছ কাটছি। মৌসূমে আসলে অধিকাংশ রস পিঠা, পুলি, পায়েস খেতে নিয়ে যায়। পিঠামোদি খরিদ্দারের চাহিদা মেটাতে পারি না। বসুন্তিয়া গ্রামের আকবর আলী জানান, এলাকায় বহু গাছি ছিল কিন্তু একশ্রেণীর ব্যবসায়ী বেশি দাম দেওয়ায় এবং কেহ কেহ গাছগুলি অপ্রয়োজন মনে করায় মালিকরা গাছ বিক্রি করে দিচ্ছেন।

গাছি মোবারক আলী বলেন, ক’বছর যশোরের একঝাক তরুন এ যশ ধরে রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং গাছি সমাবেশ করেছিলেন এবং অন লাইনে গুড়-পাটালী বেচা-কেনা করছেন। তাঁদের এ চলার পথ প্রশস্থ্য হোক। গাছি জাহান আলী বলেন, এ যশ ধরে রাখতে শুধু গাছি সমাবেশ এবং অন লাইনে গুড়-পাটালী বেচা কেনা করলেই চলবে না। খেজুরগাছ নিধন বন্ধ করে, পর্যাপ্ত গাছের জন্ম দিতে হবে। গাছ কাটার সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হবে। নতুন পরিকল্পনা হলে নতুন নতুন গাছির জন্ম হবে। গাছিরা তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। এ লক্ষে সরকারী উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় গাছি ও সুধি সমাবেশ করতে পারলে তবেই “যশোরের যশ খেজুরের রস” কথাটি পুনরুজ্জীবিত হবে বলে খেজুর গাছ কাটা গাছিদের ধারনা।

৪ নং বিদ্যানন্দকাটি ইউনিয়নের পরচক্রা গ্রামে যেয়ে কয়েকজন গাছির সাথে দেখা হয়। গ্রামের মোড়ল নফর আলী মোড়ল (৬৫) জানান, আমাদের পরচক্রা গ্রামে গাছি আব্দুল হালিম মোড়ল, আব্দুর রহমান মোড়ল, রশিদুল ইসলাম, ইসলাম খা, নূর ইসলামসহ ২৫/৩০ জন গাছি আছে, গাছ আছে প্রায় ১’হাজারটি। কিন্তু গাছির অভাবে সব গাছ কাটা সম্ভব হয়না। গাছি আব্দুল মালেক মোড়ল (৬৪) জানান, তিনি প্রায় ২ পোন অর্থাৎ ১৬০ টি গাছ কাটেন। এখন চাচ দেওয়া শেষ করে কাটের রস সংগ্রহ করছি। গাছি নফর আলী মোড়ল জানান, প্রথম চাচের রস জ্বালিয়ে ৫০০/টাকা দরে সাড়ে তিন কেজি পাটালী বিক্রি করেছিলাম।

সরেজমিনে এই সকল গাছিদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, উপজেলা ভিত্তিক প্রশিক্ষন এবং সরকারী সহযোগিতা পেলে তারা উৎসাহিত হওয়াসহ রস, গুড়, পাটালিগুড়ের উৎপাদন বৃদ্ধি হবে। ফলে গুড়ের চাহিদা অনেকাংশে মেটাতে পারবেন।

আবার আমাদের দেশে নিপা ভাইরাস আসাতে কাঁচা রস খাওয়া বন্ধ প্রায়। বেশী লোভীরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে জীবনও হারিয়েছেন। উপজেলার ত্রিমোহিনী, সাগরদাড়ী, মজিদপুর, বিদ্যানন্দকাটি, মঙ্গলকোট ও সদর ইউনিয়নে খেজুরের রস-গুড় বেশি উৎপাদন হয়।

বিদ্যানন্দকাটি ইউনিয়নের উপ সহকারী কৃষি অফিসার মোঃ আছানুর রহমান এ প্রতিবেদককে জানান, এ ইউনিয়নে অনেক খেজুর গাছ ও বেশ কিছু গাছিও আছে। খেজুর গাছ কাটা গাছিদের তালিকা নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ ইউনিয়ন থেকে শতাধিক গাছির আইডি কার্ড জমা হয়েছে।

মঙ্গলকোট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের বিশ্বাস জানান, আমার এলাকায় যথেষ্ট খেজুর গাছ আছে। গাছিদের দিকে সরকার একটু খেয়াল করলে গুড়ের চাহিদা অনেকাংশে মিটাতে পারবে বলে আশা রাখি।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন