হোম অর্থ ও বাণিজ্য কেন মেটা ছাড়লেন এর সাফল্যের রূপকার শেরিল স্যান্ডবার্গ?

বাণিজ্য ডেস্ক :

দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় যুক্ত থাকার পর পদত্যাগ করলেন ফেসবুকের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান মেটা প্ল্যাটফর্মের চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গ। প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গের পর বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে তাকে অভিহিত করা হতো।

জাকারবার্গের পাশাপাশি ফেসবুক এবং মেটা প্ল্যাটফর্মকে আজকের অবস্থানে পৌঁছানোর অন্যতম কারিগর মনে করা হয় শেরিল স্যান্ডবার্গকে।

মেটা প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার বিষয়টি বুধবার (১ জুন) এক ফেসবুক পোস্টে জানান তিনি। এদিকে শেরিল স্যান্ডবার্গের আকস্মিক পদত্যাগের খবরে ফেসবুকের শেয়ারের দরে প্রভাব পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে শেয়ারের ৪ শতাংশ দর পড়ে যায়।

ফেসবুক পোস্টে নিজের মেটা ছাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে শেরিল স্যান্ডবার্গ বলেন, ২০০৮ সালে ফেসবুকে যোগ দেয়ার সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটিতে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কাজ করার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু ১৪ বছর কাজ করার পর, এখন জীবনের পরবর্তী অধ্যায় নিয়ে কিছু করার সময় হয়েছে।

শেরিল স্যান্ডবার্গের জায়গায় মেটার চিফ গ্রোথ অফিসার জেভিয়ার অলিভান দায়িত্ব গ্রহণ করবেন বলে এক ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন জাকারবার্গ নিজেই। শেরিলের মতো অলিভানও ১৪ বছর আগে যোগ দিয়েছিলেন ফেসবুকে। তিনি ফেসবুকের পাশাপাশি মেটার অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম যেমন ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।

টেক দুনিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী শেরিল স্যান্ডবার্গ

আমেরিকার করপোরেট দুনিয়ার সবচেয়ে সফল নারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে মনে করা হয় শেরিলকে। ফেসবুকে যোগ দেয়ার আগে গুগলের গ্লোবাল অনলাইন সেল অ্যান্ড অপারেশনসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। পাশাপাশি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা স্যান্ডবার্গ বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন।

পাশাপাশি বিশ্বের টেক ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে হাই প্রোফাইল ও প্রভাবশালী নারী হিসেবেও মনে করা হয় শেরিল স্যান্ডবার্গকে।

ফেসবুকে যোগ দেয়ার পর ফেসবুকের বিজ্ঞাপন, ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো দেখাশোনা করতেন তিনি। ফলে তার ওপর এসব দায়িত্ব ছেড়ে নিজের সম্পূর্ণ মনোযোগ মেটা প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজে হাত দিয়েছিলেন মার্ক জাকারবার্গ।

শেরিলের পদত্যাগে মেটার একটি অধ্যায়ের অবসান

জাকারবার্গের পর মেটার দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তিত্ব ছিলেন শেরিল স্যান্ডবার্গ। ফেসবুকের বর্তমান বিজ্ঞাপনভিত্তিক বিজনেস মডেলের মূল রূপকার হিসেবে তাকে মনে করা হয়। তার হাত ধরেই বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মে পরিণত হওয়ার গৌরবজনক সাফল্যের পথে এগিয়েছে মেটা।

এ অবস্থায় মেটা যখন হার্ডওয়্যার পণ্য থেকে মেটাভার্সের ভার্চুয়াল জগতের দিকে রূপান্তরিত হচ্ছে, ঠিক তখনই শেরিল স্যান্ডবার্গের এ পদত্যাগের ঘোষণা অবাক করে টেকদুনিয়ার প্রায় সবাইকেই। তার এ পদত্যাগের মধ্য দিয়ে মেটার একটি অধ্যায়ের অবসান হলো বলে মনে করা হচ্ছে।

বিষয়টি নিজেই স্বীকার করেছেন ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। শেরিলের মেটা ছাড়ার ঘটনাকে একটি পর্বের সমাপ্তি বলে নিজের ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেছেন জাকারবার্গ। তিনি বলেন, মেটা আজ যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তার পেছনে শেরিল স্যান্ডবার্গের অবদান সবচেয়ে বেশি।

শেরিলের হাত ধরেই আসে মেটার বাণিজ্যিক সাফল্য

২০০৮ সালে জাকারবার্গ যখন শেরিলকে নিয়োগ দেন, তখন শেরিল ছিলেন তরুণ জাকারবার্গের থেকে ২৩ বছরের বড়। নিজের মেধা ও করপোরেট অভিজ্ঞতার মাধ্যমে একটি সাধারণ স্টার্টআপ থেকে ফেসবুককে বিশ্বের সবচেয়ে রাজস্ব আয়কারী সুবিশাল সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম হিসেবে রূপান্তর করেন শেরিল স্যান্ডবার্গ।

সে সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি ৫৬ মিলিয়ন ডলার লোকসানে ছিল এবং রাজস্ব ছিল মাত্র ২৭২ মিলিয়ন ডলার।

কিন্তু ২০১১ সালে শেয়ারবাজারে প্রথমবারের মতো আইপিও ছাড়ার সময় এর রাজস্ব উন্নীত হয় ৩৭০ কোটি ডলারে। যার মধ্যে মুনাফাই ছিল ১০০ কোটি ডলার। সবশেষ ২০২১ সালে মেটা আয় করে ১১৮ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে মুনাফা ৩৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।

মেটার সমালোচনা ও ব্যর্থতার দায় নিতে হয় শেরিলকে

অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিব্রতকর ইস্যুতে সমালোচনার মুখে পড়ে মেটা। চিফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে যার দায় পড়ে শেরিলের ওপরই।

বিশেষ করে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, ভুয়া ও মিথ্যা তথ্যের প্রসার এবং সবশেষ মার্কিন ক্যাপিটল ভবনে ট্রাম্প সমর্থকদের হাঙ্গামার পরিকল্পনা এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় ফেসবুকের অপব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে ফেসবুকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে জাকারবার্গের পাশাপাশি সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন শেরিলও। পাশাপাশি বিভিন্ন ইস্যুতে জাকারবার্গের সঙ্গে দূরত্বও সৃষ্টি হয়েছিল তার।

মূলত, এই বিষয়গুলো তার মেটা ত্যাগের পেছনে প্রভাব ফেলেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাকারবার্গ অবশ্য এ ধরনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। শেরিলের মেটা ছাড়ার সঙ্গে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান তিনি।

মেটায় গুরুত্ব হারাচ্ছিলেন শেরিল

তবে মার্কিন গণমাধ্যমে সম্প্রতি বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইদানীং মেটায় ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান হারাচ্ছিলেন শেরিল। আগে যে দায়িত্বগুলো শেরিল পালন করতেন, তার অনেকগুলোই নিজের হাতে গ্রহণ করেন জাকারবার্গ। এমনকি মেটার এক কর্মীর বরাত দিয়ে একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যম জানায়, শেরিল স্যান্ডবার্গকে বলতে শোনা গেছে যে তাকে এখন শুধু মার্ক এবং মেটার বোর্ডের ইচ্ছা অনুযায়ী চলতে হচ্ছে।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে পদত্যাগ করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত যে মেটা এবং ফেসবুকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন শেরিল। তবে গত কয়েক বছরে পাদপ্রদীপের আলোর প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিলেন জাকারবার্গ।

কারণ, একের পর এক সংকট এবং বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় মার্কিন বিভিন্ন আইনি কর্তৃপক্ষ এবং দেশটির রাজনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি নিজেই দেখতেন জাকারবার্গ।

কিন্তু অপারেশনাল প্রধান হিসেবে বিভিন্ন সংকটের বেশির ভাগ বোঝাই নিতে হচ্ছিল শেরিলকে।

এ পরিস্থিতিও হয়তো তার মেটা ছাড়ার সিদ্ধান্তের পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

মেটার দায়িত্ব ছাড়লেও আপাতত মেটার বোর্ডে থাকার কথা জানিয়েছেন শেরিল স্যান্ডবার্গ। মেটা ছাড়ার পর আপাতত নতুন কোনো দায়িত্বে যোগ দেবেন না বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন তিনি। তবে জনসেবামূলক কাজ এবং নিজের পরিবারকে আরও বেশি সময় দেয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।

 

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন