জাতীয় ডেস্ক:
‘জলে ভাসা পদ্ম আমি, শুধুই পেলাম ছলনা; ও আমার সহেলী, আমার নাই তো কোথাও কোনো ঠাঁই’। তাদের জীবন এই গানের কথার মতোই। জল ছাড়া কোথাও যেন ঠাঁই নেই। জলে জন্ম, জলে মৃত্যু, জলেই ঘর-সংসার। নিজস্ব ভিটেমাটি নেই। ১৫ থেকে ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি কাঠের নৌকাই শেষ সম্বল। আর যারা এভাবে জীবনযাপন করছে, তারা ‘মানতা’ সম্প্রদায়। জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। কিন্তু যুগ যুগ ধরে পাননি দেশের নাগরিকত্ব।
জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা জন্ম নিবন্ধন ছিল না। শত বছর ধরে তারা পটুয়াখালীর বিভিন্ন নদ নদী ও সমুদ্র মোহনায় বসবাস করলেও জীবনে কখনো ভোট দিতে পারেন নি। এমনকি ভোট সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই নেই তাদের। তবে সম্প্রতি দুই তিন বছর ধরে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এ জনগোষ্ঠীর অনেককেই আনা হয়েছে ভোটার তালিকার আওতায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত বছর তারা ভোটার তালিকার বাইরে ছিল কেন?
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সময় সংবাদ সরেজমিনে যায় পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চর মোন্তাজ মানতা পল্লীতে।
সময় সংবাদের সঙ্গে কথা হয় মানতা সম্প্রদায়ের নারী পারুজান বিবির। আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ‘আমার বয়স ৫৫ বছর। পাঁচ সন্তান আছে। কিন্তু জীবন পার করে দিলাম। শেষ বয়সে এসে ভোটার আইডি কার্ড করলাম। আমরা আগে জানতামই না ভোটার আইডি কারে বলে? আর ভোট কারে বলে? এগুলা কিছুই বুঝতাম না। বুঝমু কেমনে, জীবন যৌবন সবই কাটছো নৌকায়। আমার বাপ-মাও নৌকায় ছিল। বাইরের লোকদের সাথে আমরা মিলতাম না। তাই এগুলা জানতামওনা। এ্যাহন সরকার কইছে ঘর (মুজিব বর্ষের ঘর) দিবে, আইডি কার্ড ছাড়া নাকি ঘর দিবে না, তাই ভোটার আইডি কার্ড করলাম। এহন নাহি ভোটও দিতে পারমু।’
মনতা নারী ঝোলেখা বেগম বলেন, ‘সমাজ কারে কয় জানতাম না। ভিটেমাটি ছিল না। তাই তরের (উপরের) মানুষের সাথে আমাগো তেমন দেখাই হইতো না। দেখা হইলেও কেউ আমাদের সাথে কথা বলতো না। আমরা নৌকার বাইরের কিছু বুঝি না। এইবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ঘর পাইছি। হেই উছিলায় আইডি কার্ডও হইছে। তাই এইবার ভোট দিতে যামু। খুব খুশি লাগতাছে।’
স্থানীয়রা জানান, ভিটে-মাটি হারা নদীতে বসবাসকারী মুসলিম এই সম্প্রদায়টির নাম ‘মানতা’। জন্মসূত্রে দেশের নাগরিক হলেও সমাজ সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন শত বছরের পুরনো এ জনগোষ্ঠী কারোই ছিল না জাতীয় পরিচয়পত্র। আজ এ ঘাটে, তো কাল অন্য ঘাটে। জোয়ার ভাটার ছন্দে চলে যাদের জীবন, শত বছর পরে হলেও তাদের অনেকেই পেয়েছেন দেশের নাগরিকত্ব। তাই এবার প্রমবারের মাতো তারা যাবেন ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে। জীবনে প্রথম ভোট দেবার আনন্দ মানতাদের নৌকায় নৌকায়। ভোটের দিনের অপেক্ষার প্রহর যেন কাটছে না। বিচিত্রময় জীবনের এসব মানুষের অধিকাংশই ভোটার তালিকার আওতায় এলেও কেউ কেউ রয়েছেন, এখনও তালিকার বাইরে। আগামীতে ভোট দিতে চান তারাও।
রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, মানতা সম্প্রদায়ের মানুষ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। তারা সমাজের সঙ্গে মিশতে আগ্রহী ছিল না, আইডি কার্ড এজন্য হয়নি। যুগ যুগ ধরে সভ্যতার বাইরে থাকা মানতাদের জাতীয় পরিচয়পত্র করার পেছনের কারণ মুজিব শতবর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর। ভোট সম্পর্কে অজ্ঞ থাকায় ভোটার করার আগ্রহ ছিল না তাদের। তবে জাতীয় পরিচয়পত্র করে মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে ঘর দেয়া হলে আগ্রহ বাড়ে। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পাওয়ার পরই সভ্যতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করে তাদের গায়ে।