হোম অন্যান্যসারাদেশ করোনা কালীন সময়ে মনবতার ফেরি করে বেড়াচ্ছেন যশোরের এসপি আশরাফ হোসেন

করোনা কালীন সময়ে মনবতার ফেরি করে বেড়াচ্ছেন যশোরের এসপি আশরাফ হোসেন

কর্তৃক
০ মন্তব্য 102 ভিউজ

বি এম ফারুক, যশোর :
সত্যি ! কখনো কখনো বাস্তবতা কল্পনাকেও হার মানায় ! যখন করোনা পজিটিভের খবর শুনে কাছের মানুষগুলোও চোখের পলকে বদলে যায়। তখন সত্যিই পৃথিবীটা বড্ড আজব লাগতে শুরু করে। ঠিক এমনই সময় পাশে এসে দাঁড়ায়েছে যশোরের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন।
আর হ্যাঁ এমনটাই ঘটেছে শামীম আহম্মেদের জীবনে। তিনি পেশায় একজন ব্যাংকার। ভালোই চলছিলো তার জীবন সংসার। কিন্তু বৈষিক এই মহামারিতে তিনি হঠাৎ করোনা পজিটিভ হন। আর তখনই বুঝতে পারেন বাস্তবতাটা কত কঠিন। একে একে সবাই যেন তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পাশে নেই আপন জনও। এমন অবস্থায় ভাড়া করা বাসায় একা, এক রুমে বন্দি জীবন কাটছিলো তার। বাসার খাবারও শেষ। বাইরে যাবার কোন উপায় নেই। কি করবেন, কিছুই ঠিক করতে পারছিলেন না। এমতাবস্থায় খুবই খারাপ সময় পার করছিলেন তিনি। হঠাৎ তার মাথায় আসে যশোরের পুলিশ সুপার আশরাফ হোসেনের কথা। আশরাফ হোসেনের নেতৃত্বে জেলা পুলিশ করোনাকালে সমাজের অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়েছে। জেলা পুলিশের ফেসবুক পেইজ থেকে নম্বর সংগ্রহ করে ফোন দেন যশোর পুলিশ মিডিয়া সেলে। সেলের ইনচার্জ সোহেল মাতুব্বর তার কাছ থেকে বিস্তারিত শোনেন। আর সেই সাথে বিষয়টি সম্পর্কে যশোর রির্জাভ অফিসের আরও-১ এসআই(নিরস্ত্র) জামাল উদ্দিন জামানকে অবহিত করেন। এরপর জামাল উদ্দিন পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেনকে অবহিত করেন। পুলিশ সুপার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলেন। করোনা পজিটিভ শামীম আহম্মেদের বাসায় পুলিশ সুপারের উপহার সামগ্রি পৌঁছে দেন।
শুধু তাই নয়, যশোরের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন পুলিশ জনগণের বন্ধু তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। তিনি করোনাকালীন সময়ে জেলার সর্বস্তরের মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন। মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার পুলিশ হবে জানতার এই শ্লোগান তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ১২ হাজার মানুষের খাবার দিয়েছেন। প্যাকেট ভর্তি খাদ্যদ্রব্য নিয়ে হতদরিদ্র মানুষের কাছে হাজির হয়েছেন আশরাফ হোসেন। যশোর শহরের বিভিন্ন বস্তিতে ঘুরে ঘুরে নিজ হাতে চাল, ডাল, তেল এবং সাবান তুলে দিয়েছেন।
ঘুম ভেঙে উপহার পেয়ে যারপরনাই খুশি করোনাভাইরাসের প্রভাবে কাজহারা মানুষগুলো। তাদের কাছে এটি স্বপ্ন মনে হয়েছে। ঘুম ভেঙে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পেয়ে মহাখুশি কাজহারা মানুষগুলো।
শরাফত হোসেন নামে একজন ট্রাকচালক বলেন, এসপি সাহেব ঘরের দরজায় খাদ্য নিয়ে এসেছেন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। কাজে বের হতে না পারায় ঘরে যা ছিল, তা শেষ। চাল ডাল না পেলে ছেলে-মেয়ের খুব কষ্ট হচ্ছিল।
সুরুজ মিয়া নামে একজন রাজমিস্ত্রির হেলপার জানান, ঘরে বসে আছি। এক টাকাও রোজগার নেই। এমন সময় পুলিশের পক্ষ থেকে চাল ডাল পেয়ে খুব খুশি হয়েছি। পুলিশ রাতে বাড়ি এসে খাবার দিয়ে যাবে একথা কখনও চিন্তা করেননি। সকালে কাউকে বললে কেউ বিশ্বাস করবে বলেও মনে হয় না। রিকশা চালক হামিদ গাজী ও তার স্ত্রী রহিমা খাতুন বলেন, ‘যে পুলিশের ভয়ে থাকি, সেই পুলিশের এসপি এই দুর্দিনে গভীর রাতে খাদ্য দিচ্ছেন আমাদের মতো গরীব মানুষদের। এটা যেন কল্পনাও করা যায় না।’
গোটাবিশ্বের মতো বাংলাদেশও করোনাভাইরাসের রোষানলে। এর প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে জনগণকে নিজবাড়িতে থাকার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। দেশের মানুষ কার্যত ঘরে বন্দি। এই বন্দিদশার কারণে সবচেয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন দিন এনে দিন খাওয়া হতদরিদ্র মানুষ। সরকার এই দরিদ্র মানুষদের জন্য ত্রাণ সহায়তা চালু করেছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যে কারণে তাদের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছে যশোর পুলিশ। নিজেদের অর্থায়নে তারা শুরু করেছে খাদ্য সহায়তার কাজ। আর কাজটির জন্য তারা বেছে নিয়েছে রাতের আঁধারকে। রাতের শুনশান নীরবতাকে ভেদ করে তারা ছুটে চলেছে হতদরিদ্রদের ঘর থেকে ঘরে। দরজায় গিয়ে কড়া নেড়ে সেইসব মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছেন নিত্য সামগ্রি। দিনেরবেলায় অনেক মানুষ জড়ো হয়ে যায়, যে কারণে রাত বেচে নিয়েছেন। আগেই খোঁজ নিয়ে তালিকা করা কিছু পরিবারের সদস্যদের এই সহায়তা দেওয়া হয়েছে। যাতে স্টে হোম ও সোশাল ডিসটেন্সের নিয়ম রক্ষা হয়।
মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন রাতভর শহরের নাজির শংকরপুর, ইসহাক সড়ক, রেল গেটসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে হতদরিদ্র পরিবারকে ১০ কেজি চাল, ৫ কেজি ডাল, ২ লিটার তেল ও ২টি করে সাবান দেন। আর এভাবে জেলার ১২ হাজার মানুষের কাছে খাবার সহায়তা দিয়েছেন।
জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে পুলিশ অফিসাররা কিছু টাকা-পয়সা একত্র করে হতদরিদ্র মানুষদের নিত্যপণ্য বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। দিনে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে যায় তাই রাতে খাবার পৌছানোর এ ব্যবস্থা। করোনা কালীন সময়ে জেলা পুলিশের উদ্যোগে তাদের এই সহায়তা অব্যাহত থাকবে।
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সালাউদ্দিন শিকদার জানান, ‘করোনা প্রতিরোধে লকডাউনের কারণে সমাজে খেটে খাওয়া হতদরিদ্র শ্রেণির মানুষের অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করে এসপি সাহেব নিজ উদ্যোগেই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।’
মহানতার ফেরিওয়ালা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, ‘অসহায় মানুষদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের হাতে খাদ্য তুলে দেয়া বিষয়টি অতি আনন্দের। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে পুলিশের এই কার্যক্রম চলবে।’
পুলিশ সুপার বলেন, যশোর পুলিশ করোনামুক্ত করার জন্য সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটি পুলিশ সদস্যের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আগেই পদক্ষেপ নিয়েছি। প্রথমে পুলিশ লাইনের পুলিশ সদস্যদের তিন ভাগে ভাগ করে নিয়ে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আলাদা করা হয়। যাতে একটি গ্রুপ আক্রান্ত হলে বিকল্প গ্রুপ দিয়ে কাজ করাতে পারি।
পরবর্তী সময়ে প্রত্যেকটি থানা, ফাঁড়ি, ক্যাম্পের পুলিশ সদস্যদের তিন ভাগে ভাগ করেছি। যশোর পুলিশের এ মডেল আইডিয়া পরবর্তী সময়ে খুলনা রেঞ্জের অন্যান্য জেলা পুলিশ বিভাগে অনুসরণ করা হয়েছে। আমরাই প্রথম পুলিশ লাইন, থানা, ফাঁড়ি ও ক্যাম্পের প্রধান ফটকে জীবাণুনাশক বুথ তৈরি করেছি। প্রত্যেকটি সদস্য যতবার প্রবেশ ও বের হয়েছেন, জীবাণুনাশক স্প্রে করা হয়েছে। এতে তারা জীবাণুমুক্ত হয়েছেন। প্রথম থেকেই প্রত্যেকটি পুলিশ সদস্যকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে। আমার পুলিশ সদস্যদের মধ্যে কোনো আতঙ্ক নেই। যশোরে পুলিশ সদস্যরা সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
সচেতনতা প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার আশরাফ হোসেন বলেন, প্রথম থেকেই আমরা মানুষকে সচেতন করার কাজ শুরু করি। জেলায় লক্ষাধিক লিফলেট, হ্যান্ডবিল বিতরণ করেছি। এরপর বিদেশ ফেরত মানুষকে চিহ্নিত করেছি। তাদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে বাড়ি বাড়ি লাল নিশানা টানিয়ে দিয়েছি। এরপর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর থেকে অনেকেই এলাকায় এসেছেন। তাদেরও তালিকা করেছি। এরপর স্থানীয় থানা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে সরবরাহ করেছি। তাদেরও ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে দেশে আসা মানুষের তালিকা করে তাদেরও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করেছি।
জেলা প্রশাসক, সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সিভিল সার্জনের সঙ্গে আমিও বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনাভাইরাস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেছি। করোনা আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধিতে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমরা যৌথ টিম কথা বলেছি। অনেকের বাড়িতে বাজার করে দিয়েছি। আমরা মানুষকে বুঝিয়ে ঘরে রাখতে পেরেছি।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, বিউটিশিয়ান, ম্যাজিশিয়ান, হিজড়া, বেদে, পতিতালয়ের বাসিন্দাদের মাঝে খাবার, ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে। জেলা পুলিশের ওয়েবসাইটে হটলাইন সেবা চালু করেছি। সেখানে অসংখ্য ফোন পেয়েছি। নামের তালিকা করেছি। যাচাই করে তাদের ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছি। কেউ যাতে একাধিকবার না পায়, কিংবা বাদ না পড়ে সেটি দেখছি। ঈদুল ফিতরে ঈদ উপহার দিয়েছি।
আর এসব কাজে তিনি সমাজের বিত্তবানদের প্রতি এই পরিস্থিতে অসহায় লোকজনের পাশে দাঁড়াবার আহ্বান জানান।
মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন যশোর জেলার আগে নীলফামারীর পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি যশোরের পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন আশরাফ হোসেন ২৪তম বিসিএস ক্যাডার এর অফিসার। কর্মজীবনে তিনি নীলফামারীর পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের আগে সিআইডি ও ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আশরাফ হোসেন গাজীপুর জেলার কৃতি সন্তান। স্ত্রী পেশায় একজন চিকিৎসক। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক আশরাফ হোসেন অবসরে গান গাইতে ও ছবি আঁকতে ভালোবাসেন। তার কর্মজীবনের সফলতার কারনে তিনি রাষ্ট্রপতি পদকে ভুষিত হন।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন