নিজস্ব প্রতিনিধি :
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার আটঘরা-জেঠুয়া এলাকায় কপোতাক্ষ নদের চরভরাটি প্রায় ৫০ বিঘা জমি ভূমিহীন নামধারী ভূমিদুস্যারা দখল করে নিয়েছে। ছোট ছোট প্লট করে সেখানে ধান রোপন করা হয়েছে। এসব ভূমিহীন নামধারীদের তালিকায় শিক্ষক, সরকারি চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তিরা আছেন। অনেকের দশ থেকে বিশ বিঘা জমি থাকার পরও ভূমিহীন বনে গেছেন তারা। সম্প্রতি আটঘরা-জেটুয়া গ্রামের ১৩২টি পরিবার চরভরাটি জমি নিজেদের মধ্যে বন্টন করে ধান চাষ করেছেন।
অথচ কপোতাক্ষ খনন প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বে সরকারের কাছে থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পাওয়া ৩৪ জন ভূমিহীনের জমি খননের মধ্যে চলে যায়। ওই সময়ে আন্দোলনের মুখে খুলনার সাবেক বিভাগীয় কমিশনার আব্দুস সামাদ পাশর্^বর্তী চরভরাটি জমি দেওয়ার প্রতিশ্রতি দিয়ে খনন কাজ চলমান রাখেন। কিন্তু বিভাগীয় কমিশনারের দেওয়া প্রতিশ্রæতি বর্তমানে কোনো কাজে আসছে না। দু’টি গ্রামের প্রভাবশালীরা পাশর্^বর্তী চরভরাটি প্রায় ৫০ বিঘা জমি দখল করে নিয়েছে। এতে বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত ভূমিহীনরা।
তালা উপজেলার খেশরা ইউনিয়নের তহশীলদার গগণ দেবনাথ জানান,আটঘরা গ্রামের ৮২ জন স্বাক্ষর করে চরভরাটি জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার জন্য সম্প্রতি একটি আবেদন করেছেন। তবে সাবেক বিভাগীয় কমিশনার স্যারের কাছে কয়েক বছর আগে ওই জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার জন্য একটি আবেদন করেন ৩৪ জন ভূমিহীন। ওই আবেদনে তিনিসহ (কমিশনার স্যার), সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য, তালা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ভূমিহীনদের পক্ষে সুপারিশ করেন। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সার্ভেয়ার চাওয়া হয়েছে। তবে প্রকৃত ভূমিহীনরা ছাড়া চরভরাটি জমি কেউ পাবেন না বলে জানান তিনি। বুধবার (১২ আগষ্ট) সকালে তালা উপজেলার আটঘরা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কপোতাক্ষ নদ’র ভেঁড়িবাধের পাশে ছোট ছোট প্লট করে চাষাবাদ করা হচ্ছে। সেখানে কেউ চাষ করছেন, কেউ বা ধান রোপন করছেন। কেউ জমি থেকে ঘাষ পরিস্কার করছেন। চাষাবাদ চলছে পুরোদমে। তবে বাড়ি আছে এক তলা, আছে এক থেকে তিন বিঘা পর্যন্ত পানের বরজ। তারাও দখল করছেন চরভরাটি ওই জমি।
এসময় জালালপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও আটঘরা গ্রামের সুকেশ দাশ জানান, চরভরাটি জমি আটঘরাসহ পাশর্^বর্তী গ্রামের ১৩২টি পরিবার নিজেরা ভাগ করে নিয়ে চাষাবাদ করেছেন। তবে তারা সরকারের কাছে থেকে কোনো বন্দোবস্ত পায়নি। সম্প্রতি তারা বন্দোবস্ত পাওয়ার জন্য তালা উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে আবেদন করেছেন।
আটঘরা গ্রামের বাসিন্দা সুব্রত দাশ জানান, তিনি জালালপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তার বাড়ি আছে একতলা। তিনিও চরভরাটি ওই জমি দখল করছেন। তার জমিতে তিনি ধান চাষ করেছেন বলে জানান। এ গ্রামের আরেক বাসিন্দা তপন দাশ নির্বোদ জানান, তার বাড়ির আয়তন পাঁচ বিঘা। এরমধ্যে এক বিঘা পানের বরজ ও ফসলি জমি আছে। সেখানে ফসল হচ্ছে তার। তিনিও চরভরাটি প্রায় দুই বিঘা জমি দখল করছেন।
আটঘরা গ্রামের নিতাই দাশ জানান, তিনি পল্লীবিদ্যুৎ এ চাকুরী করেন। তারপর তিনি চরভরাটি ওই জমি ভোগদখল করছেন। এমন ব্যক্তি আছেন তপন দাশ, সংকর দাশ, শিশির দাশ সহ অনেকে। তবে পাশর্^বর্তী জেটুয়া গ্রামের ভূমিহীন কার্তিক চন্দ্র ঘোষ জানান, কপোতাক্ষ খননের সময় তার সরকারের দেওয়া বন্দোবস্ত জমি নদের মধ্যে চলে যায়। পরে বিভাগীয় কমিশনার স্যার তাকে অন্যত্র জমি দেওয়ার আশ^াষ দেন। কিন্তু পাশর্^বর্তী চরভরাটি জমি প্রভাবশালীরা দখল করে চাষাবাদ করছে। সেখানে তারা গেলে তাদেরকে নানা ভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। জেটুয়া গ্রামের জগদিশ অধিকারী জানান, তিনি চরভরাটি ওই জমি চাষাবাদ করতে গিয়ে ছিলেন। কিন্তু আটঘরা গ্রামের প্রভাবশালীরা ওই জমি দখল করতে দেয়নি। এমন বক্তব্য ভূমিহীন অনন্ত অধিকারী, বিনোদ অধিকারী, অনিল অধিকারীসহ অনেকের।
জালালপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রামপ্রসাদ দাশ জানান, বর্তমানে ভূমিহীনদের নামে প্রভাবশালীরা চরভরাটি ওই জমি দখল করছে। তাদের ১৩২ জনের মধ্যে ২০ জনও ভূমিহীন নেই। প্রকৃত ভূমিহীনরা ওই জমিতে যেতে পারছে না। জালালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম মফিদুল হক লিটু জানান, আটঘরা-জেটুয়া এলাকায় চরভরাটি প্রায় ৫০ বিঘা জমি দুই গ্রামের ১৩২টি পরিবার ভাগ করে চাষাবাদ করছে। তারা সম্প্রতি বন্দোবস্ত পাওয়ার জন্য আবেদন করেছে। কিন্তু তাদের বৈধ কাগজ পত্র নেই। কপোতাক্ষ খনন বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুর রশিদ জানান, কপোতাক্ষ খননের সময় ভূমিহীনদের কিছু জমি প্রকল্পের মধ্যে চলে যায়। এনিয়ে ভূমিহীনরা আন্দোলন শুরু করে।
পরে বিভাগীয় কমিশনার আব্দুস সামাদ সাহেব সরেজমিনে এসে তাদের পাশর্^বর্তী স্থানে জমি দেওয়ার আশ^াস দেন। কিন্তু বর্তমানে অবৈধ ভাবে গ্রামবাসি চরভরাটি ওই জমি দখলে রেখেছেন। তালা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মেহেদী রাসেল জানান, শুনেছি প্রভাবশালীরা চরভরাটি ওই জমি দখল করেছে। দু’টি পক্ষ চরভরাটি ওই জমি নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে। এজন্য দুই পক্ষের সংঘর্ষ এড়াতে বিষয়টি নজরদারীতে রাখা হয়েছে। তালা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) খন্দকার রবিউল ইসলাম জানান, বিষয়টি নিয়ে আবেদন পেয়েছি। তবে চরভরাটি জমি দখল করা সম্পর্ন অবৈধ। যারা অবৈধ ভাবে দখল করে আছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনের সাংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মুস্তফা লূৎফুল্লাহ বলেন, ভূমিহীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে তিনি সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু কপোতাক্ষ নদের চরভরাটি জমি প্রভাবশালীরা পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সরকার যদি বন্দোবস্ত দেয়, সেটি পাবে প্রকৃত ভূমিহীনরা।