জাতীয় ডেস্ক :
নানারকম চা সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকলেও স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া সোনালি রঙয়ের চায়ের কথা আমরা খুব কম মানুষই জানি। যে চা স্বচ্ছ কোনো পেয়ালায় পরিবেশন করলে তা সোনালি রঙ ধারণ করে, ওপরে ভাসে খাবার যোগ্য স্বর্ণের প্রলেপ। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে মাথায় রেখে এ চায়ের নাম দেয়া হয় ‘গোল্ডেন বেঙ্গল বা সোনার বাংলা’। যে চায়ের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘লন্ডন টি এক্সচেঞ্জ’।
বাংলাদেশের সিলেটে উৎপাদিত এ গোল্ডেন বেঙ্গল চায়ের দাম ধরা হয়েছে প্রতি কেজি ১৬ কোটি টাকা। বিষয়টা গল্পের মতো শোনালেও যা একেবারেই সত্য। অনেকটা আঁতকে ওঠার মতো ব্যাপার।
‘দ্য গোল্ডেন বেঙ্গল’ নামের এ চা চলতি বছরের মে মাসে বাজারে পাওয়ার কথা থাকলেও তা এখনো বাজারে আসেনি। এ চায়ের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি প্রতি কেজি চায়ের দাম নির্ধারণ করেছে ১৪ লাখ পাউন্ড। বাংলাদেশি টাকার হিসাবে যা প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের চা বাগানে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে তৈরি করা এবং সোনার প্রলেপ দেয়া সোনালি রঙের এই চা হতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দামি চা-এমনটাই দাবি করছেন এর উৎপাদকরা।
বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে গত কয়েক বছর অত্যন্ত গোপনে বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করে এ চায়ের চাষ করা হয়। বিদেশি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মীরা এই চা তৈরিতে কাজ করেন। পুরো প্রক্রিয়ায় মেশিনের কোনো সহায়তা নেয়া হয়নি। চা গাছের শুধু দুটি সোনালি পাতা দিয়েই তৈরি করা হয় এই চা।
জানা গেছে, এই চা ব্ল্যাক টি প্রকারের হলেও স্বচ্ছ পেয়ালায় পরিবেশন করলে তা সোনালি বর্ণ ধারণ করে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত এই চা প্রস্তুত করতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে চার বছর। অথচ এ সাড়ে চার বছরে ৯০০ কেজি চা থেকে মাত্র ১ কেজি সোনালি চা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। যেই চায়ের পাতায় আবার মেশানো হয়েছে ২৪ ক্যারেট সোনার প্রলেপ। যা কিনা খাওয়ার উপযোগী।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এ গোল্ডেন বেঙ্গল টির স্বাদ নিয়েছিলেন।
লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধানে গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে গোপনে এ চা চাষ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে বাংলাদেশের চা শিল্পের গবেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশে এত দামি চা চাষের কথা দীর্ঘদিন ধরে বলা হলেও এ ধরনের চায়ের বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।
লন্ডন টি এক্সচেঞ্জের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অলিউর রহমান বলেন, একটি বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করে এই চা তৈরি করা হয়েছে। বিদেশি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিকরা অনেক যত্ন সহকারে এই চা তৈরি করতে কাজ করেছেন। পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো মেশিনের সহায়তা নেয়া হয়নি। মূলত চা গাছের মাত্র দুটি সোনালি পাতা দিয়েই এই চা তৈরি করা হয়।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় অনেক গাছে সোনালি পাতা থাকে না। কখনও কখনও এই সোনালি পাতা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করার পর প্রশিক্ষিত কর্মীদের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এসব চা পাতা সংগ্রহ করতে থাকি। এরপর এটি একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চায়ে রূপান্তরিত করি। এক পর্যায়ে গোল্ড ফ্লেক্স বা গোল্ড পাউডারের সঙ্গে তা মেশাই।
লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের বিভিন্ন দামি ব্র্যান্ডের চা সংগ্রহ করে বিক্রি করে। কোম্পানির কর্মকর্তারা দাবি করেন যে, তারা সারা বিশ্বের একাধিক রাজপরিবারকে চা সরবরাহ করে। তবে এবারই প্রথম নিজেদের তত্ত্বাবধানে চা উৎপাদন করছে তারা। এ ছাড়া উৎপাদন, বিশেষ পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিশেষ প্রশিক্ষিত জনবল ব্যবহারের কারণে এই চায়ের দাম এতো বেশি।
তবে কয়েক বছর আগে বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশেষ জাতের ‘ব্ল্যাক টি’ চা গাছের কচি সোনালি পাতা সংগ্রহ করে, গানের ধাতু দিয়ে গরম করলে সেই পাতা থেকে ঘাম বের হয়। আবার শুকিয়ে গেলে সে পাতা সোনালি হয়ে যায়। আর এই পাতা থেকে যে চা তৈরি করা হয় তার রঙ হয় সোনালি।
তবে ঠিক কী প্রক্রিয়ায় সোনার বাংলার চা তৈরি হয়, তা জানা যায় না। বাংলাদেশের একাধিক চা কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে এই চা সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
চায়ের নানা জাতের মধ্যে বিশ্বে এখন পর্যন্ত ‘হোয়াইট টি’ দামি চা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে হোয়াইট টি-র চাষাবাদ খুব একটা হয় না। বাংলাদেশের প্রায় সব চা বাগানে ব্ল্যাক টি-র চাষাবাদ হয়ে থাকে। এর বাইরে গ্রিন টি, ইনস্ট্যান্ট টি, ওলং টির কিছুটা চাষ হচ্ছে।
এদিকে ব্রিটিশ-ভারতীয় বাংলাদেশে বাণিজ্যিক চা উৎপাদন ১৮৫৪ সাল থেকে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানের মাধ্যমে শুরু হয়।
বাংলাদেশের চা বোর্ডের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ১৬৭টি চা বাগান থেকে রেকর্ড ৯ কোটি ৫ লাখ ৬ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়। এসব চায়ের বেশিরভাগই দেশের বাজারে বিক্রি হয়। ওই একই বছরে রফতানি হয়েছে মাত্র তিন লাখ ১৩ হাজার কেজি চা। সবচেয়ে বেশি রফতানি হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে, ১ লাখ ৮০ হাজার কেজি চা। এরপর বেশি রফতানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানে।