হোম অর্থ ও বাণিজ্য উন্নয়নের তুলনায় ঋণের গতি বেশি

উন্নয়নের তুলনায় ঋণের গতি বেশি

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 25 ভিউজ

নিউজ ডেস্ক:
রাজস্ব আয় কম, বিনিয়োগে মন্দা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আইনশৃঙ্খলা অবনতি এবং অর্থনীতির সামগ্রিক দুর্বলতায় বাংলাদেশের সরকারি ঋণভার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যয় বাড়লেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব বাড়ছে না। ফলে ঘাটতি মেটাতে সরকার আগের চেয়ে বেশি ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় গত এক বছরে সরকারের মোট ঋণ বেড়েছে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা, যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম দ্রুত ঋণবৃদ্ধির ঘটনা। যদিও আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর উন্নয়নকাজে ধীরগতি চলছে।

অর্থ বিভাগের সর্বশেষ ঋণ বুলেটিন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুনে সরকারি মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ২১ লাখ ৪৪ হাজার ৩৪ কোটি টাকা, যা এক বছর আগের ১৮ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকার চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ বেশি। এই ঋণের মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৯ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রায় ১১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী—গত ২০২৪-২৫ অর্থবছর ব্যাংক থেকে সরকার নিট ৭২ হাজার ৩৭২ কোটি টাকার ঋণ নেয়, যা গত চার অর্থবছরের মধ্যে ছিল সর্বনিম্ন। আর গত অর্থবছরের জন্য সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৬ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা কম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণের পরিমাণ জিডিপির অনুপাতে এখনও নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পরিশোধ-সক্ষমতা, সুদের চাপ এবং রফতানি-রাজস্বের দুর্বলতা আগামী বছরগুলোতে বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুয়ায়ী, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। সে হিসাবে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলেই সরকারের ঋণ স্থিতি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বেড়েছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতিবছর গড়ে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা করে বেড়েছে। অথচ উন্নয়ন কাজে ধীরগতি থাকা সত্ত্বেও গত এক বছরে সরকারের ঋণ বেড়েছে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা।

বিনিয়োগ স্থবির, কর্মসংস্থান সৃষ্টি নেই

দেশে দীর্ঘদিন ধরেই বেসরকারি বিনিয়োগের গতি কম। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ সুদের হার, ডলারের সংকট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করেছে। ফলে উৎপাদন খাত সম্প্রসারণ না হওয়ায় নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে না।

বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পরিকল্পিত অনেক শিল্প প্রকল্প আটকে গেছে অর্থায়ন ও আমদানি জটিলতার কারণে। বিদ্যমান কারখানাগুলো উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে বাজার সংকোচন ও উচ্চ ব্যয়ের চাপে। এর ফলে শ্রমবাজারে নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি না হওয়া তো বটেই, অনেক খাতে কর্মী ছাঁটাইও বেড়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, যেখানে বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে, উৎপাদন বাড়বে, রাজস্ব বাড়বে—সেখানেই এখন চাকা থমকে আছে। ফলে উন্নয়নচক্র মন্থর হলেও ঋণ নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই সরকারের সামনে।

উন্নয়নকাজে ধীরগতি, বাড়ছে ঋণ-নির্ভরতা

সরকার পরিবর্তনের পর চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। অনেক মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প ব্যয় কমেছে ১০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগোচ্ছে না। কিন্তু উন্নয়ন ব্যয় কমলেও ঋণ কমছে না, বরং বিপরীতভাবে ঋণই হচ্ছে সরকার পরিচালনার প্রধান ভরসা। অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, “উৎপাদন ও উন্নয়ন থেমে গেলে ঋণ ভবিষ্যৎ আয়ে পরিণত হয় না—বরং দায়ের পাহাড় তৈরি করে।”

রাজস্ব সংকটে একমাত্র ঋণই বাঁচার পথ

রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বিগত কয়েক বছর ধরেই পূরণ হচ্ছে না। অর্থবছর শেষে ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে লাখ কোটি টাকার মতো। এই ঘাটতি মেটাতে বাধ্য হয়েই অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর নির্ভর করছেন নীতিনির্ধারকরা। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব আহরণ জিডিপির তুলনায় সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ রাজস্ব আহরণে সবচেয়ে পিছিয়ে। ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং বাজার সংকোচনের কারণে দুই বছর ধরে রাজস্ব সংগ্রহে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে প্রায় ৭-৭.৫ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কমের তালিকায়। পাকিস্তানের হার ৯-১১ শতাংশের মতো, শ্রীলঙ্কার ৮ শতাংশের ওপরে এবং ভারতের কর-জিডিপি অনুপাত ১১-১২ শতাংশের কাছাকাছি ঘোরে। অর্থাৎ প্রতিবেশী দেশগুলো কর আহরণে যেখানে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে, বাংলাদেশ সেখানে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। কম কর বেস (যারা করের উপযুক্ত কিন্তু তারা কর থেকে দূরে রয়েছেন), কর ফাঁকি, অদক্ষ প্রশাসন ও আমদানি-নির্ভর পরোক্ষ করের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা—এসব কারণে দেশের রাজস্ব আয়ের সক্ষমতা এখনও দুর্বল। ফলে বাজেট বাস্তবায়ন, উন্নয়ন ব্যয় ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মোট রাজস্ব আদায় দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। নির্ধারিত সময়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজস্ব বাড়ছে না, উন্নয়ন ব্যয় কমানো যাচ্ছে না, ফলে সরকার ঘাটতি মেটাতে বাধ্য হয়ে বেশি ঋণ নিচ্ছে। এর ফলে ঋণ-নির্ভরতার ঝুঁকি আরও বাড়ছে।

বড় প্রকল্প, বাজেট সহায়তা ও বৈদেশিক ঋণের দ্রুত বৃদ্ধি

গত এক দশকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ একাধিক মেগা প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির হার সবচেয়ে দ্রুত, যেখানে সরকারি ও সরকারি-গ্যারান্টিযুক্ত ঋণ ১৩ বছরে তিনগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন— করোনা মহামারি-উত্তর সময়ে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের বাজেট সহায়তা এবং বড় বড় প্রকল্পের ব্যয়ই মূলত বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির প্রধান কারণ।

এডিপি বাস্তবায়ন হার নেমে আসে ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে

দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে অভূতপূর্ব স্থবিরতার কারণে এডিপি বাস্তবায়নে নামতে হয়েছে ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হার নেমে আসে ৬৮ শতাংশেরও নিচে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন, বরাদ্দ সংকোচন এবং স্থগিতাদেশের কারণে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে উন্নয়ন খাতে মন্থরতা দেখা দেয়—যার প্রভাব সামষ্টিক অর্থনীতিতেও পড়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) জানায়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এসে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা নতুনভাবে মূল্যায়ন করছে। এতে বহু প্রকল্প বাদ পড়েছে, অনেক প্রকল্প সাময়িকভাবে স্থগিত, আবার বেশ কিছু প্রকল্পের বরাদ্দ ব্যাপকভাবে কমানো হয়েছে। সব মিলিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ধীরগতি প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে।

অক্টোবর থেকে কিছুটা গতি ফিরছে

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেও একই মন্থরতা দেখা গেলেও অক্টোবর মাসে এসে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। জুলাই-অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম চার মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। তবে বাস্তবায়নের হার বেড়েছে বলা হলেও টাকার অঙ্কে ব্যয় কমেছে। চলতি চার মাসে ব্যয় হয়েছে ১৯ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা, যেখানে গত বছর ছিল ২১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা।

ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশেষ নজরদারি

এডিপি বাস্তবায়নে এই অস্বাভাবিক পতনে সরকারের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানায়, ডিসেম্বর পর্যন্ত বাস্তবায়ন বাড়াতে বিশেষ তদারকি চলছে। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে বাস্তবায়ন দ্রুততর করার নির্দেশনা দিয়েছেন। সরকারি ক্রয়ের জটিলতা দূর করতে নতুন আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং শতভাগ অনলাইনভিত্তিক ক্রয় ব্যবস্থা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।

টাকার বরাদ্দ কমায় ব্যয়ও কম

চলতি অর্থবছরে এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে দুই লাখ ৩৮ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপি (আরএডিপি) অনুমোদনের পর বরাদ্দ আরও কমতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। গত অর্থবছরের আরএডিপি ছিল দুই লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। আইএমইডির মতে, বরাদ্দ কমানো, প্রকল্প সংশোধন ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সংকোচনের কারণে ব্যয় কমলেও দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল পাওয়া যেতে পারে।

খাতভিত্তিক ব্যয়

প্রথম চার মাসে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ—৪ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। অপরদিকে স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ ব্যয় করেছে মাত্র ৭৭ কোটি টাকা। এ সময় চলমান প্রকল্প ছিল ১ হাজার ১৯৮টি, এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন থেকে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৮১০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণ থেকে ৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।

ঋণ বাড়ার সঙ্গে সুদ পরিশোধের চাপও তীব্র

ঋণ যত বাড়ছে, সুদ ব্যয়ও তত দ্রুত বাড়ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার সুদ হিসেবে পরিশোধ করেছে এক লাখ ৩২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের সুদ ২১ শতাংশ বেড়েছে, দেশীয় ঋণের সুদ ১৬ শতাংশ বেড়েছে, ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদ ব্যয় ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে সুদ পরিশোধই বাজেটের সবচেয়ে বড় একক ব্যয় খাত হয়ে উঠতে পারে। ইতোমধ্যে ২০২৫-২৬ সালের বাজেটে সুদের জন্য এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের সতর্ক বার্তা: ‘ঋণের চাপ নিয়ন্ত্রণে না এলে ঝুঁকি বাড়বে’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. এম কে মুজেরী বলেন, ‘‘ঋণ-জিডিপি অনুপাত এখনও সীমার মধ্যে থাকলেও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা দ্রুত কমছে, যা আসন্ন বছরের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।’’ তিনি মনে করেন, ঋণের অর্থ যদি উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার না হয়, তবে তা পরিশোধযোগ্য থাকবে না।

বাজেটের বড় অংশ সুদ পরিশোধে চলে যাচ্ছে, যা উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে ব্যয় সংকুচিত করবে। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক ও বাছাই করা নীতি প্রয়োজন। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা এখন সতর্ক। বাজেট সাপোর্ট হিসেবে হঠাৎ নতুন ঋণ নেওয়া হবে না। কারণ ঋণের চাপ শেষ পর্যন্ত জনগণের ওপরই পড়ে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘চীনের ঋণ বিষয়ে বাংলাদেশ সতর্ক রয়েছে, কারণ আফ্রিকার বহু দেশ চীনের ঋণের চাপ সামলাতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে। ভারতের লাইন অব ক্রেডিট থেকেও ৫-৬টি ঋণ সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।’’

আইএমএফ: বৈদেশিক ঋণ এখন ‘মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ’

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণকে এখন ‘মধ্যম-ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে মূল্যায়ন করছে। ডিএসএ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঋণ-রফতানি অনুপাত ১৬২ শতাংশ, যা নিরাপদ সীমার অনেক ওপরে। ঋণ-রাজস্ব অনুপাত দ্রুত বাড়ছে, রফতানিতে সংশোধিত নিম্নমুখী তথ্য ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে। আইএমএফ তাই ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের ওপর ৮.৪৪ বিলিয়ন ডলার সীমা বেঁধে দিয়েছে।

দীর্ঘমেয়াদে টেকসই ঋণের জন্য নতুন কৌশল প্রয়োজন

অর্থ বিভাগের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ঋণ টেকসই রাখতে হলে কর শনাক্তকরণ, প্রশাসনিক দক্ষতা, উন্নয়ন প্রকল্প বাছাই এবং বাস্তবায়নে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি। না হলে ২০২৬-২৭ থেকে রূপপুরসহ বড় প্রকল্পের ঋণের কিস্তি শুরু হলে চাপ আরও বাড়বে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানায়, বড় ঋণের কিস্তি বাড়ায় ২০২৬-২৭ থেকে ঋণ পরিশোধ দ্রুত বাড়বে, যা ২০৩৪ সাল পর্যন্ত চলবে। এরপর ধীরে ধীরে চাপ কমতে পারে।

ঋণ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে ‘ডিএমও’ গঠনের উদ্যোগ

আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকার একটি সমন্বিত ঋণ ব্যবস্থাপনা কার্যালয় গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই কার্যালয় দেশীয় ঋণ ইস্যু তদারকি, একীভূত ঋণ ডাটাবেজ তৈরি, ঋণ ঝুঁকি মূল্যায়ন, বার্ষিক ঋণগ্রহণ পরিকল্পনা এবং নিলাম ক্যালেন্ডার নির্ধারণ করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিএমও কার্যকর হলে ঋণ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরবে, তথ্যের অসঙ্গতি কমবে এবং সরকারের ঋণের ব্যয় দীর্ঘমেয়াদে হ্রাস পাবে।

সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে ঝুঁকি আরও তীব্র হবে

বাংলাদেশ বর্তমানে মধ্যম আয়, উচ্চ উন্নয়ন ব্যয় এবং দুর্বল রাজস্ব কাঠামোর একটি জটিল পর্যায়ে দাঁড়িয়ে। এ অবস্থায় রাজস্ব, রফতানি, রেমিট্যান্স না বাড়লে, নতুন ঋণ বাছাইয়ে সতর্কতা না এলে, আগামী কয়েক বছর দেশের ঋণচাপ আরও বাড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখনই যদি রাজস্ব সংস্কার, প্রকল্প বাছাইয়ের কঠোরতা, ঋণ ব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে ঋণ-সুদ পরিশোধই আগামী বাজেটের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াবে।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন