জাতীয় ডেস্ক :
সম্প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় পূজায় কুমিল্লার নানুয়ার দীঘিরপাড়ের অস্থায়ী একটি পূজামণ্ডপে মুসলিম সম্প্রদায়ের পবিত্র কোরআন শরিফ পাওয়ার ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনার জেরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা সৃষ্টি হয়। অনেক স্থানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরআন রাখার ঘটনাটি তদন্ত করতে গিয়ে কয়েকট স্থানের সিসিটিভি’র ভিডিও ফুটেজ পুলিশের হাতে আসে।
পরবর্তীতে সিসিটিভি’র ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ ঘটনায় সম্পৃক্ত ইকবাল হোসেন নামে এক যুবককে শনাক্ত করে পুলিশ। সেসব ভিডিও ফুটেজ পরবর্তীতে সংবাদমাধ্যমেরও হাতে এসেছে।
সিসিটিভির সেসব ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কুমিল্লায় পূজামণ্ডপের ৫০০ গজ দূরের দারোগাবাড়ি মাজারসংলগ্ন মসজিদ থেকে কোরআন নিয়ে মন্দিরে ঢোকেন ইকবাল হোসেন। অভিযুক্ত এই ইকবাল হোসেন কীভাবে, কখন মসজিদে যান এবং বের হন। এরপর মণ্ডপের দিকে যান এবং মণ্ডপ থেকে গদা হাতে ফেরেন তা ফুটেজে অনেকটা স্পষ্ট।
তবে, এ ঘটনায় ইকবাল ‘ঘুঁটি’ হিসেবে ব্যবহার হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দা, পুলিশ ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। তার পেছনে অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মূল ভূমিকা পালন করেছে। ঘটনার আট দিন পর বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) রাত ১০টার দিকে কক্সবাজারের সুগন্ধা সৈকত এলাকা থেকে ইকবালকে আটক করার কথা জানায় পুলিশ।
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, ইকবালকে ব্যবহার করে নেপথ্যে যারা ভূমিকা রেখেছে, এখন তাদের শনাক্ত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ইকবালের জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে অনেকের মুখোশ উন্মোচন হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ইকবাল কারও দ্বারা নির্দেশিত হয়ে বা কারও প্ররোচনায় এটা করেছে বলে আমরা মনে করি। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে সবকিছু উদ্ধার করতে পারব। নোয়াখালীতে যারা সহিংসতায় জড়িত ছিল, তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে তাকে আমরা চিহ্নিত করেছি। মাজারের সঙ্গে যে মসজিদ, সেখানে সে গিয়েছে। একবার-দুবার নয়, তিনবার গিয়েছে। সেখানে মসজিদের দুজন খাদেম ছিল, তাদের সঙ্গে সে কথা বলেছে।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল কে এম আজাদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, নাটকের প্রথম পর্বে ছিল ইকবাল। পেছন থেকে আরও যারা এই নাটকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তারা মূলত আসল ‘খেলোয়াড়’।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, গত ১২ অক্টোবর রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে মসজিদে প্রবেশ করতে দেখা যায় মাজারের খাদেম ফয়সাল ও হাফেজ হুমায়ুনকে। এরপর রাত ১০টা ৫৮ মিনিটে মসজিদে প্রবেশ করেন ইকবাল। এ সময় খাদেম ফয়সাল ও হাফেজ হুমায়ুন ইকবালের সঙ্গে কথা বলতেও দেখা যায়। ঠিক রাত ১১টায় তারা তিনজনই সেখান থেকে বেরিয়ে যান।
এরপর রাত ২টা ১২ মিনিটের দিকে পুনরায় মসজিদে প্রবেশ করে কোরআন নিতে দেখা যায় ইকবালকে। এ সময় পাশেই অজ্ঞাতপরিচয় একজন ঘুমিয়ে ছিলেন, আরেকজন ছিলেন নামাজরত অবস্থায়। এর দুই মিনিট পর মেঝেতে কোরআন রেখে তাকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। তারপর রাত ২টা ১৮ মিনিটে মসজিদে আবারও প্রবেশ করে মেঝেতে রাখা কোরআন নিয়ে মসজিদ থেকে বের হতে দেখা যায় তাকে। মসজিদ থেকে বের হয়ে তাকে মূল সড়কে উঠে মন্দিরের দিকে হেঁটে যেতে দেখা যায়।
আরেকটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ইকবাল পূজামণ্ডপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। পূজামণ্ডপের রোড থেকে জগন্নাথ মন্দির রোডের দিকে এগিয়ে যান। এরপর তিনি জগন্নাথ মন্দির রোড থেকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক চকবাজার শাখার দিকে এগিয়ে যান। পূবালী ব্যাংক মোড়ের পাশের গলিতে প্রবেশ করেন তিনি। সেখানে অবস্থান করে নৈশপ্রহরীদের সঙ্গে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা যায় তাকে। সর্বক্ষণই তার হাতে কোরআন দেখা যাচ্ছিল। কথাবার্তার পরে তাকে জগন্নাথ মন্দিরের দিকে যেতে দেখা যায়। সেই রোডে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর পূজামণ্ডপের দিকে এগিয়ে যান ইকবাল।
অন্য আরেকটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, রাত ৩টা ১২ মিনিটে যুবকটির হাতে কোরআন শরিফ নেই। তিনি এ সময় গদা কাঁধে নিয়ে মন্দিরের পাশে পুকুরপাড়ের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছিলেন। এ সময় তিনি চারপাশে তাকিয়ে দেখছিলেন কেউ তাকে দেখছে কি না।
চিহ্নিত ব্যক্তির প্রস্থানের একটু পরে রাত ৩টা ১৩ মিনিটের দিকে ৯৯৯ এ কল দেওয়া একরামকে সেখানে দেখা যায়। এরপর তাকে আবার ৩টা ২৩ মিনিটের দিকে দারোগাবাড়ি মসজিদে প্রবেশ করতে দেখা যায়। এ সময় তার কাছে কোরআন কিংবা গদা কিছুই দেখা যায়নি। এরপর ১৩ অক্টোবর পুকুরপাড়ে উত্তেজিত জনতার সামনে তাকে কথা বলতে দেখা যায়।
উল্লেখ্য, শারদীয় দুর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিন গত বুধবার (১৩ অক্টোবর) ভোরে কুমিল্লা শহরের নানুয়াদিঘির উত্তরপাড়ে দর্পণ সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন দেখা যায়। এরপর কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে ওই মণ্ডপে হামলা চালায় একদল লোক। সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়।
এরপর রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু বসতিতে হামলা করে ভাঙচুর, লুটপাট ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। হিন্দুদের মন্দির-মণ্ডপসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা হয়েছে দেশের আরও কয়েকটি এলাকায়।
এদিকে তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, নানুয়ারদীঘিরপাড়ের পূজামণ্ডপে শুরুতে ঢুকতে ব্যর্থ হয়েছিলেন ইকবাল হোসেন। পূজামণ্ডপটিতে শুরুতে ইকবাল লোকজন দেখে ফিরে আসেন। এরপর তিনি গিয়েছিলেন ওই মণ্ডপের অদূরে দিগম্বরীতলার গুপ্ত জগন্নাথ মন্দিরে। সেখানে গেটের তালা ভাঙতে ব্যর্থ হন ইকবাল। এরপর আবার ফিরে আসেন নানুয়ারদীঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে। সেখানে ওই সময় লোকজন না থাকার সুযোগ নিয়ে তিনি কোরআন শরিফ রেখে যান।