বাণিজ্য ডেস্ক :
বাংলাদেশ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ঋণ চেয়েছে। এনিয়ে হচ্ছে আলোচনা ও সমালোচনা। অনেকেই ভাবছেন আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়া মানেই দুশ্চিন্তা। কিন্তু আদৌ কী এমন? এক্ষেত্রে জানতে হবে আইএমএফ কী, কোন প্রেক্ষাপটে ঋণ দিয়ে থাকে এ প্রতিষ্ঠানটি, ঋণের ক্ষেত্রে কী ধরনের শর্ত মেনে চলতে হয় আবেদনকারীদের।
১৯৩০ সাল। এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। দেশে দেশে দেখা দেয় বেকারত্ব, শেয়ারবাজার ধসে পড়ে, বন্ধ হয়ে যায় ব্যাংকের লেনদেন, খাদ্যদ্রব্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম হয় আকাশচুম্বী। মানুষের চোখেমুখে কেবল হতাশার ছাপ। এ মারাত্মক হতাশার নাম ছিল ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’। গ্রেট ডিপ্রেশন থেকে উত্তরণের পথ হয়ে জন্ম নেয় আইএমএফ।
অন্যান্য ব্যাংক থেকে আইএমএফ কিছুটা আলাদাভাবে কাজ করে। বিশ্বব্যাংক কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক যেমন বিভিন্ন প্রজেক্টে ঋণ দিয়ে থাকে, আইএমএফ ঠিক সেভাবে ঋণ দেয় না। দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য (বাজেট সহায়তা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, ঋণের দায় মেটানো) আইএমএফ সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকে ঋণ দিয়ে থাকে। অনেক উন্নয়নশীল দেশ যখন ঋণের দায় মেটাতে ব্যর্থ হয় কিংবা রিজার্ভ সংকট থেকে বাঁচতে চায় তখন আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। এক্ষেত্রে হঠাৎ করে কোনো দেশ আইএমএফের ঋণের আবেদন করলে একটু বাঁকাচোখে দেখা হয়- বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের দুর্দশার পড়ে- যারা কি না আইএমএফের ঋণ পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।
কিন্তু বাংলাদেশের আইএমএফের ঋণ চাওয়ার প্রেক্ষাপটটি একদম আলাদা। যদিও অনেক বিদেশি বার্তা সংস্থা (ব্লুমবার্গ, দ্য গার্ডিয়ান) বাংলাদেশের এ ঋণকে ‘বেইল-আউট’ ঋণ বলছে, কিন্তু আদতেও এটি বেইল-আউট ঋণ নয়। বেইল-আউট ঋণ হচ্ছে অনেকটা আত্মসমপর্ণের মতো। যখন একটি দেশ দেউলিয়া হয়ে যায় কিংবা দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে থাকে তখন সে যদি আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য দ্বারস্থ হয়, তখন মূলত সে ঋণকে বেইল-আউট ঋণ বলা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন কিছুই ঘটেনি। এখানে বাংলাদেশের চাওয়া ঋণকে বেইল-আউট ঋণ বলা মানে হচ্ছে এক ধরনের ‘প্রোপাগান্ডা’ ছড়ানো যে, বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। যেখানে দেশের রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের কম-বেশিতে আছে, কোনো ধরনের ঋণখেলাপির রেকর্ড নেই, সেখানে বাংলাদেশের আবেদন করা ঋণকে কোনোভাবেই বেইল-আউট বলা যায় না।
বাংলাদেশ বরাবরই ঘাটতি বাজেট দিয়ে থাকে। সে হিসেবে এবারের বাজেটে ঘাটতি ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা কিনা মূল বাজেটের এক তৃতীয়াংশ। একদিকে বাজেট ঘাটতি মেটানো, অন্যদিকে আমদানি ব্যয় সামাল দেয়া। এক্ষেত্রে আইএমএফের ঋণকে অনেকে ‘পরিত্রাণমূলক আর্থিক সহায়তা’ হিসেবে দেখছে। এবার বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে- যা এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ। এর আগে প্রায় এক দশক আগে বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ৯৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল।
আইএমএফ থেকে ঋণ পেতে হলে তাদের বেশ কিছু শর্ত মেনে নিতে হয়। বিশেষ করে তেল, বিদ্যুৎ, সারের ওপর থেকে ভর্তুকি তুলে দেয়া ও ব্যাংকের সুদের হার অনির্দিষ্ট করে দেয়ার মতো শর্তগুলো অনেকটা শঙ্কার চোখে দেখা হয়। তবে একটি দেশ কী ধরনের শর্ত মানবে ও কতটুকু মানবে তা নির্ভর করছে আলোচনার ওপরে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এমন কোনো আশঙ্কাজনক অবস্থায় নেই, যেখান থেকে তাদেরকে আইএমএফের দেয়া সব ধরনের শর্ত মেনে নিতে হবে।
সারা বিশ্বে এক ধরনের বড় রকমের অর্থনৈতিক অস্থিরতা কাজ করছে। এ অস্থিরতার ফসল ব্যাপকহারে মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার এখন ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ যা বিগত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বর্তমানে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি ৩ হাজার ৮৬ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি। আমদানি ব্যয় ও প্রবাসী আয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির কারণে চলতি হিসাবের ঘাটতি এখন ১ হাজার ৭২৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এটিও বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আর সব মিলিয়ে সামগ্রিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৩৭১ কোটি ডলার। অথচ আগের অর্থবছরেও ছিল ৭৫০ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত।
এদিকে দিনের পর দিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১১ শতাংশ। খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হয়েছে ১১২ টাকা দরে, যা সর্বকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। এদিকে আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ নেমে গিয়েছিল ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। এমতবস্থায় অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইএমএফের ঋণ অনেকটা আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেবে। এক্ষেত্রে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের অনেক আগেই আইএমএফের ঋণ নেয়া দরকার ছিল। কিন্তু তারা অনেক দেরি করে ফেলেছে এবং এর ফলও ভোগ করতে হচ্ছে তাদের। বাংলাদেশ যে সময়ে এসে আইএমএফের ঋণ চাচ্ছে, এটিকে উপযুক্ত সময় মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদরা।
এ ব্যাপারে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার সময়পোযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সময়ে আইএমএফের ঋণ বাজার স্থিতিশীল করবে ও মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক স্থিরতা আনবে।
সুদের হার বাড়ানোর ব্যাপারে মনসুর বলেন, আইএমএফের কিছু শর্ত রয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক সুদের হার বাড়ানো একটি। এটি মূলত কতটুকু বাড়বে ও কত সময়ের জন্য বাড়বে তা নির্ভর করছে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ওপরে। অল্প কিছু সময়ের জন্য সুদের হার বাড়িয়ে লাভের ভাগ নিজেদের দিকে টানতে পারলে, সেটা আমাদের জন্য সার্থকতা।
ভর্তুকির ব্যাপারে তিনি বলেন, ভর্তুকির ব্যাপারে আমাদের একটু কৌশুলি হতে হবে। বিদ্যুতখাতকে ঢেলে সাজানোর দাবি অনেক দিনের। ভারতের দিকে তাকান- ওদের বিদ্যুতের দাম নির্ভর করে বাজারের ওপরে। দাম ওঠা-নামার ভেতরেই থাকে। আমরা চাইলে ওদের পথ অনুসরণ করতে পারি।
বাংলাদেশের ঋণ শোধের রেকর্ড সবসময়ই ভালো। কিন্তু বর্তমানে আর্থিক অস্থিরতার বাজারে এখন থেকেই বাংলাদেশকে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঋণের বকেয়া খাতা খুললে দেখা যায়, বাংলাদেশ ভারত, রাশিয়া ও চীন থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে। প্রায় একই পরিমাণ ঋণ এডিবি ও বিশ্বব্যাংক থেকে নিলেও, এ তিন দেশের ঋণ শোধ করতে হবে আগামী ১৫-২০ বছরের মধ্যে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুসারে, বিদায়ী অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের আসল, সুদসহ ২০১ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছে ইআরডি।
বকেয়া ঋণের ব্যাপারে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কঠিন শর্তের এসব ঋণ নেয়ায় কয়েক বছর পরই ঋণ পরিশোধে বাড়তি চাপ আসবে, এটা অবধারিত। চীন, রাশিয়া ও ভারতের ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হলে প্রতিবছর গড়ে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হবে।
আইএমএফের ঋণের বেশকিছু দিক নিয়ে ভাবনার বিষয় রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ঋণের বিকল্প পথ নিয়ে কেউ কথা বলেনি। বেইল-আউটের মতো অবস্থা বাংলাদেশের হওয়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু ঋণের চাপে যাতে বড় রকমের ধাক্কা বাংলাদেশকে সামলাতে না হয়, বাজার যাতে অস্থিতিশীল হয়ে না পড়ে- সেক্ষেত্রে এখন থেকে প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়া নিঃসন্দেহে দূরদর্শিতার পরিচায়ক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
