হোম ফিচার যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষায় আলিয়া ভাটের লড়াই

বিনোদন ডেস্ক :

বিংশ শতাব্দীর ৫০-৬০-এর দশকে মুম্বাই শহরে গাঙ্গু লড়েছিলেন এক অসীম সাহসী লড়াই। লড়েছিলেন কামাঠিপুরার যৌনকর্মীদের সম্মানের দাবিতে। আজব শহর মুম্বাই। হিন্দি সিনেমার চকচকে প্রাণকেন্দ্রের অলিগলিতে লুকিয়ে আছে হিংস্রতা, রহস্য, রক্তপাত।

তারই মধ্যে যৌনপল্লির হতভাগ্য মেয়েদের জন্য লড়াই করেছিলেন তাদেরই মতো হতভাগ্য এক সাতাশ বছরের তরুণী গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ি। সিনেমা ভালোবাসত কিশোরী গাঙ্গু। তার চোখভর্তি স্বপ্ন নায়িকা হওয়ার। গুজরাটের কাথিয়াওয়াড়ের এক প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীর পনেরো বছর বয়সী মেয়ে গাঙ্গু তার প্রেমিক রামনিকের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিল স্বপ্নের শহর মুম্বাইয়ে। স্বপ্ন ও প্রেমে বিভোর গঙ্গু বোঝেনি রামনিকের সুকৌশলে পাতা ফাঁদ। হিন্দি ফিল্মের চোখধাঁধানো দুনিয়ার পরিবর্তে তাই তার ঠাঁই হলো অন্ধকার-স্যাঁতসেঁতে গলিতে, রাত নামলে যেখানে শরীর বেচে শতাধিক মেয়ে। তেমনই আর এক কিশোরী মধুকে নিজের গল্প শোনানোর সময় ফ্ল্যাশব্যাকে বানসালি তুলে ধরেছেন গাঙ্গুর অতীত।

গাঙ্গুর মোড় ঘুরে যায় এলাকার মাফিয়া ডন করিম লালার সহায়তায়। লালা একজন নিষ্ঠাবান পাঠান। তার দাপটে থরথর করে মুম্বাইয়ের লোকজন। সেই লালার দলের এক পাঠানের হাতে যখন ধর্ষিত হতে হয় গাঙ্গুকে, তখন একরোখা গাঙ্গু ইনসাফ চান লালা, তথা তার করিম ভাইয়ের কাছে। ইনসাফ মেলে, সঙ্গে মেলে স্বীকৃতি ও ক্ষমতা। সেই ক্ষমতার জোরে গাঙ্গু নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নেন এবং দাপুটে রাজিয়া বাইকে হারিয়ে জিতেও যান। কিন্তু ক্ষমতার চাকচিক্য তাকে বিচ্যুত করেনি নিজের পরিসর থেকে, কামাথিপুরার কোঠি ও তার অগণিত বারবনিতার মধ্যেই ছিল তার ঘর।সঞ্জয় লীলা বানসালির ছবি মানেই বিরাট এক ক্যানভাসজুড়ে আলো ও রঙের খেলা, মহাকাব্যিক ফ্রেম, ঘটনার ঘনঘটা‌, অতিনাটকীয় সংলাপ। এসবের মধ্যে বাস্তবের গাঙ্গুবাই কেমন ছিলেন, তা হুবহু জানতে চাওয়া বৃথা, সেই গাঙ্গুবাইকে বানসালির চোখধাঁধানো সেটে খুঁজতে যাওয়াও অর্থহীন। গাঙ্গুর চরিত্র নির্মিত হয়েছে জাইদির বইয়ের ছায়ায়। মুম্বাইয়ের তেরো জন ‘মাফিয়া কুইন’কে নিয়ে বইয়ের তেরোটি অধ্যায়, তার মধ্যে একজন গাঙ্গু। বইটি পড়ে কেউ ছবিটি দেখতে গেলে প্রথম থেকে বেশ খানিক সাদৃশ্য পাবেন। তবে ছবি যত এগোয়, বোঝা যায় গাঙ্গু, জাইদির বই থেকে উঠে এলেও ক্রমেই ডালপালা শাখাপ্রশাখা নিয়ে প্রসারিত হয় বানসালির প্রত্যাশিত ফর্মুলায়। ছবির শেষে তিনি একাধারে মা, রক্ষক, কামাথিপুরার প্রেসিডেন্ট ও সমাজকর্মী। পরনে সাদা শাড়ি, চোখে রোদচশমা ও হাতে মদের বোতল–এই সবকিছু নিয়ে গাঙ্গু এক বৃহৎ মহিরুহ, যার বাইরেরটা রুক্ষ হলেও অন্তর স্নেহ ও সহমর্মিতায় পরিপূর্ণ। যেমনটা আছে ছবির সংলাপেই–‘প্যায়ার কো গালি দেতি হ্যায় পর উস্কি গালি মে ভি প্যায়ার হ্যায়’–ভালোবাসাকে সে গালিগালাজ করে, কিন্তু তার গালিগালাজেও ভালোবাসা আছে।

এমন এক চরিত্রে কেমন অভিনয় করলেন আলিয়া ভাট, তা জানার কৌতূহল অনেক মানুষেরই। সিনেমার ঝলক থেকেই মোটামুটি স্পষ্ট ছিল, এ ছবিতে গঙ্গুবাই একাই একশ। খানিক প্রত্যাশিতভাবেই এক ইঞ্চিও জমি তিনি ছাড়েননি অন্য কাউকে। শুরু থেকে শেষ কার্যত রাজত্বই করলেন আলিয়া। প্রথম প্রথম তাকে অবশ্যই সাতাশ বছরের জেদি গাঙ্গু হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল; কিন্তু ছবির চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছেন তিনি। নাচে-গানে-সংলাপে একেবারে মাতিয়ে রাখেন তিনি। ‘ঢোলিড়া’ গানে তার নাচ মনে করায় বানসালিরই অন্য এক ছবি ‘রামলীলা’র ‘নাগাড়ে সং ঢোল’। তবে আলিয়ার পাশাপাশি তার প্রিয় বন্ধু কমলির চরিত্রে ইন্দিরা তিওয়ারি অসাধারণ। গাঙ্গুর মতো চরিত্রের পাশেও তিনি শুরু থেকে শেষ নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন, কোনো অংশে কম যাননি। নজর কেড়েছেন শান্তনু মহেশ্বরী। আলিয়ার সঙ্গে তার দৃশ্যগুলো বেশ মিষ্টি এবং উপভোগ্য। রাজনৈতিক জটিলতা, কূটনীতি ও যৌনপল্লির ফ্যাকাশে জীবনযাপনের মধ্যে এই দৃশ্যগুলো টাটকা বাতাসের মতো। সীমা পাহওয়া অভিনয় করেছেন গাঙ্গুবাইয়ের কোঠির দেমাকি মালকিন শীলা মাসির চরিত্রে। শুরু থেকেই যার সঙ্গে গঙ্গুর ঠান্ডা লড়াই চলে। তার মতো দক্ষ অভিনেত্রীর প্রতি এই চরিত্র সুবিচার করতে পারল না। এ কথা বললেও ভুল হবে না যে, তার অভিনয়-ক্ষমতাকে ভালো মতো ব্যবহারই করা হয়নি। একই কথা খাটে জিম সর্ভ অভিনীত উর্দু পত্রিকার সাংবাদিকের চরিত্রেও। ছোট চরিত্রে অজয় দেবগণ ও বিজয় রাজ ভালো।

তবে বানসালির অন্য সব ছবির মতোই এ ছবিতেও কেন্দ্রীয় চরিত্র বা অভিনেতা নয়; বরং বিরাট সেটের বহর, যা বানসালির যেকোনো ছবির শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। এই ছবির রং ধূসর। ছবিজুড়ে যৌনপল্লির ধূসর ক্যানভাসের মাঝে সাদা শাড়ি পরিহিত গাঙ্গু সবসময়ই আকর্ষণের কেন্দ্রে, তার উপস্থিতি চোখ টানে সর্বক্ষণ। ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ধরা কামাথিপুরার ফ্রেমগুলো মুম্বাই শহরের সমান্তরাল ও আড়াল জীবনের ছবি আঁকে। মনে পড়তে পারে, যৌনকর্মীদের জীবন নিয়ে তৈরি শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত আর এক স্মরণীয় ছবি ‘মান্ডি’র কথা। লো অ্যাঙ্গেল ও হাই অ্যাঙ্গেল শট ব্যবহার করে বৈচিত্র্য আনা হয়েছে দৃশ্য-বয়নে। বেশ কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত উপহার পাবেন দর্শক। তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় বোধহয় কমলীর মৃত্যুদৃশ্য। মৃত্যু মানেই সাদা পোশাক, শোকের ঘনঘটা, নির্জনতা ও নীরবতা। বানসালি দেখালেন অন্যরকম এক শেষ বিদায়। কমলীর মরদেহ সেখানে সাজানো হয়েছে লাল শাড়িতে। তাকে ঘিরে রয়েছে তার অজস্র সহচরী, কেউ সাজিয়ে দিচ্ছেন তো কেউ কমলীর ঘন কালো চুলে বেণি বেঁধে দিচ্ছেন শেষবারের মতো। মাঝখানে চোখ বন্ধ করে বসে রয়েছেন কমলী। মুখে গভীর প্রশান্তি। একঝলকে দেখে কারও মনে হবে না তার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর সঙ্গে বানসালি আশ্চর্যভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন জীবনকে, সাহচর্যকে, নারীর সঙ্গে নারীর বন্ধুত্বকে।

ছবির শুরু থেকে শেষ অসংখ্য সিটি মারার ও হাততালি কুড়ানোর মতো সংলাপ। বস্তুত সেট ও সংলাপ এই দুই-ই ‘গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়’-এর মূল আকর্ষণ। এর জোরেই দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা বসে থাকার ধৈর্য দেখানো যায়। যদিও কোনো কোনো দৃশ্য অহেতুক ঠেকে। শীলা মাসি রেডিও শুনতে ভালোবাসতেন বলে তার মৃত্যুর পর হঠাৎ আকাশবাণীর থিম মিউজিকের ব্যবহার খানিক হাস্যকর। আজাদ ময়দানে সব দর্শক-শ্রোতার পরনে সাদা পোশাক কেন বা গাঙ্গুর সমস্ত সন্তানই (যাদের শিক্ষার অধিকারের জন্য গাঙ্গু লড়াই করেন) বা মেয়ে কেন তা বোঝা যায় না। এই রকম ছোট ছোট অসংগতি বাদ দিলে আড়াই ঘণ্টার জমজমাট বিনোদনের জন্য এ ছবি বেশ উপযুক্ত। এককথায় যদি বলতে হয়, তবে এই ছবি গাঙ্গুবাইয়ের উদ্‌যাপন। সেই সঙ্গে আজীবন যা যা মতামত তিনি রেখে এসেছেন, তারও উদ্‌যাপন এই ছবি, যার একটি হলো বেশ্যাবৃত্তিকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া।

মিলল কি আইনের স্বীকৃতি? উত্তর মিলুক বা না-মিলুক, যৌনকর্মীদের অবস্থা নিয়েও যদি একটি মূলধারার ছবি অন্তত ভাবায়, এই-বা কম কী?

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন