নিউজ ডেস্ক:
ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে রাজধানীর বনানীর কড়াইল বস্তি। আগুনে ঘরপোড়া মানুষের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে আশপাশের পরিবেশ। সব হারিয়ে নিঃস্ব বস্তিবাসী। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন খোলা মাঠে, কেউ বা ধ্বংসস্তূপের সামনে নির্বাক চেয়ে আছেন। কেউ আবার ধ্বংসস্তূপে খুঁজছেন বেঁচে থাকার শেষ আশা। খাবার পানিটুকুর জন্যেও তাদের চেয়ে থাকতে হচ্ছে অন্যের দিকে। ঘটনাস্থলে ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্য-পানিসহ প্রয়োজীন সামগ্রী দিচ্ছেন অনেকে।
বুধবার (২৬ নভেম্বর) সরেজমিন জান গেছে, স্থানীয় বাসিন্দা মুরশিদ মিয়া বসে ছিলেন অগ্নিকাণ্ড শুরুর স্থানের পাশে তার ছেলে আল আমিনের কাপড়ের দোকানে। তিনি বলেন, মঙ্গলবার মাগরিবের নামাজের জন্য মসজিদে যাই ওজু করতে। সেখান থেকেই ব্কিট শব্দ শুনে দৌড়ে এসে দেখি আগুন লেগেছে। পরে দ্রুত ছেলে ও নিজে বের হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাই।
তিনি বলেন, আগুন লাগে গুদারাঘাটের কবরস্থান রোডের মিন্টু মিয়ার বাড়ি থেকে। বাড়ির রান্না ঘরের গ্যাস সিলিন্ডারের পাইপ ছিদ্র হয়ে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
গুদারাঘাটের অপর কাপড়ের দোকানি মো. রাসেল জানান, আগুন লাগার সময় তিনি দোকানে ছিলেন। হঠাৎ দেখেন মিন্টু মিয়ার বাড়িতে আগুন লেগেছে। নেভানোর জন্য বাসার লোকজন পানি ছিটানো শুরু করে। কিন্তু আগুন দ্রুতই ছড়িয়ে পরে।
এ বিষরয় জানতে মিন্টু মিয়ার বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার মেয়ে শিউলিকে দেখা যায়। তার পাশেই কান্নারত ছিল তার ব্নে।
শিউলি বলেন, আগুনের পর থেকে আমার মা নিখোঁজ। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবা (মিন্টা মিয়া) মাকে খোঁজায় ব্যস্ত।
শিউলি বলেন, এখানে আমাদের ২০টির মতো ঘর ছিল। দুটিতে আমরা থাকতাম। বাকিগুলো ভাড়া দেওয়া ছিল। গতকাল বিকালে মা বাসায় ছিলেন। হঠাৎ তিনি আগুন দেখতে পান। পরে বাসায় থাকা ছোট দুই ভাগনিকে বোনের হাতে দিয়ে দ্রুত বের হতে বলেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আনতে তিনি আবারও ঘেরে প্রবেশ করেন। এরপর থেকেই তার খোঁজ পাচ্ছি না।
শিউলি বনানীর একটি বায়িং হাউসে চাকরি করেন বলে জানান।
মো. গিয়াস উদ্দিন। পেশায় গাড়ি চালক। কাজ করেন বনানী এলাকায়। কড়াইল বস্তিতে তার ছিল ১১টি ঘর। মঙ্গলবারের আগুনে সেগুলো পুড়ে গেছে। গিয়াস উদ্দিন জানান, ১৯৯৯ সাল থেকে দখলসূত্রে তিনি এক টুকরো জমি নেন। এরপর সেখানে টিনসেডের ১১টি ঘর ও একটি দোকান করেন। ঘরগুলো ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকা করে ভাড়া দেওয়া ছিল। আর ফার্মেসির দোকানটি থেকে পেতেন ৪ হাজার ৫০০ টাকা। ঘরগুলোর মধ্যে নিজে থাকতেন দুটি রুমে। বাকিগুলো ভাড়া দেওয়া ছিল। ভাড়ার টাকা ও নিজের চাকরির আয় দিয়ে পরিবার নিয়ে ভালোই চলছিল তার। কিন্তু গতকালকের আগুন সব শেষ হয়ে গেছে। একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
গিয়াস উদ্দিন বলেন, এই ঘরগুলো আবারও তৈরি করতে কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা লাগবে। এত টাকা এখন কোথায় পাবো।
তিনি আরও বলেন, এর আগেও দুবার বস্তিতে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হই। এই নিয়ে তিনবার হলাম। প্রথমবার ২০০৪ সালে। দ্বিতীয়বার ২০১৭ সালে। আর এবার লাগলো। প্রথমবার প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম কম থাকায় ঘর তুলতে খচর কম হয়েছিল। দ্বিতীয়বারের আগুনে ১৫-১৬ লাখ টাকা খরচ হয়। ঋণ করতে হয় বেশ কিছু টাকা। আর এবার অনেক খরচ হবে।
কড়াইল বস্তির বউবাজার ইউনিটে একটি ছোট রুম নিয়ে থাকতেন মিনা আক্তার। তিনি তেজগাঁও এলাকায় একটি প্রতিষ্ঠানের ক্লিনার হিসেবে চাকরি করেন। আট হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন মিনা। এই আয় দিয়েই ঘর ভাড়া, ছেলেকে পড়ানোর খরচ এবং অন্যান্য দৈনন্দিন খরচ মেটান তিনি। আগুনে তার বাসার সব কিছুই পুড়ে গেছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মিনা বলেন, আমি বস্তির দোতালায় একটি ছোট রুম নিয়ে থাকতাম। ভাড়া দিতাম ৩ হাজার ২০০ টাকা। ঘরে দামি কিছু না থাকলেও একজোড়া কানের দুল ছিল। তাও পুড়ে গেছে।
মিনা জানান, তার একটি ছেলে সন্তান আছে। ১১ বছর বয়সী ছেলে বিমানবন্দর এলাকায় একটি মাদ্রাসায় পড়ছে। ছেলের বয়স যখন ১১ মাস, তখন তার স্বামী মারা যান। এরপর থেকে ছেলেকে নিয়ে এই বস্তিতেই থাকেন।
নিজের ছেলের পুড়ে যাওয়া কাপড় দেখিয়ে মিনা বলেন, আমার ছেলের পরনের কাপড় ও নিজের কাপড় সব পুড়ে গেছে। যা পড়ে আছি তাই আমার বর্তমান সম্বল।
কড়াইল বস্তিতে লাগা আগুনে পুড়ে গেছে বস্তির অন্তত ১ হাজার ৫০০ ঘর। সেই সঙ্গে পুড়েছে ঘরে থাকা টাকাসহ মূল্যবান সামগ্রীও। ক্ষতিগ্রস্তত হয়েছেন অনেক বস্তিবাসী।
বস্তির পুড়ে যাওয়া অংশগুলোতে মূল্যবান সামগ্রী খুঁজতে দেখা যায় তিন-চার কিশোরকে। তারা জানায়, যে জায়গায় তারা খোঁজাখুঁজি করছে, সেই স্থানেই ছিল তাদের ঘর। আগুনে তাদের ঘরে থাকা টাকাসহ সব কিছুই পুড়ে গেছে।
তারা আরও জানায়, আগুন নেভানোর পর বুধবার সকাল থেকে টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার এবং রূপার তৈরি জিনিস খেঁজা শুরু করা হয়। টাকাগুলো পুড়ে গেছে। তবে রূপার কিছু অংশ পাওয়া গেছে।
একইভাবে বস্তির অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদেরও তাদের ঘরে থাকা টাকাসহ মূল্যবান সামগ্রী খুঁজতে দেখা যায়। তবে তারা কিছুই পাননি। টাকা পেলেও সেগুলো পুড়ে গেছে।
বস্তির বাসিন্দা মনিরা আক্তার বলেন, তিনি গুলশানের নিকেতনে বাসাবাড়িতে কাজ করেন। তার স্বামী রিকশাচালক। এই বস্তিতে ১৮ বছর ধরে থাকেন। তিল তিল করে ঘরে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গড়েছিলেন। কিন্তু আগুন সব শেষ করে দিয়েছে।
মনিরা বলেন, ঘরে নগদ ৪৫ হাজার টাকা ছিল। সব পুড়ে গেছে।
মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। একে একে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট গিয়ে পাঁচ ঘণ্টা চেষ্টার পর রাত ১০টা ৩৫ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে আজ সকাল সাড়ে ৯টায় ১৬ ঘণ্টা পর আগুন সম্পূর্ণ নেভানোর কথা জানায় স্থংস্থাটি। আগুনে ১ হাজার ৫০০ ঘর পুড়ে গেছে।
