নিউজ ডেস্ক:
পরীক্ষা-নিরিক্ষা ছাড়া, মানুষকে না জানিয়ে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার। রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধির সঙ্গে ইসির নির্বাচনি সংলাপের তিনি এসব কথা বলেন।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার বলেন, এমন একটা পরিস্থিতিতে আপনারা নির্বাচন করতে যাচ্ছেন সেটাকে এক কথায় বলা যায় ভয়ঙ্কর। এই পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারলে আপনাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইসিহাসের পাতায়। আর যদি না পারেন তাহলে কী হতে পারে সেটাও জানেন। পোস্টার ব্যালটে ভোটের ব্যাপারটা খুবই সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। কারণ এখানে বিতর্ক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে পিআর নিয়ে দাবি উঠেছে। নতুন কোনও সিস্টেম চালু করতে হলে এক্সপেরিমেন্ট করতে হয়। সেটা আমাদের করা হয় নাই। তাই পরীক্ষা-নিরিক্ষা ছাড়া, মানুষকে না জানিয়ে এই (পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন) ধরনেই সিদ্ধান্ত নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
নির্বাচন কমিশনকে চাপ দেওয়া উচিত নয় মন্তব্য করে ইয়াহইয়া আখতার আরও বলেন, কোন কোন দল নির্দিষ্ট মার্কা দাবি করছে। ওই মার্কা না হলে নাকি তারা নির্বাচনে যাবে না। এটা ঠিক না। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন একটা প্রতিষ্ঠান। এটা তাদের নিজস্ব এখতিয়ার। এখানে তাদের চাপ দেওয়া উচিত নয়।
সংলাপে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, এই নির্বাচনটা বাংলাদেশের জন্য একটা ট্রানজিশন। এটার মাধ্যমেই বোঝা যাবে, আগামীর বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে। আজ আপনারা যে চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছেন, সেটা নিয়েই দায়িত্বটা পালন করতে হবে। এটা সুচারুভাবে পালন করবেন সেটা কিন্তু মানুষ দেখতে চায়। তবে আপনারা একটা ভালো নির্বাচন করতে পারবেন বলে আমি মনে করি।
সাংবাদিক, কলামিস্ট ও চর্চার সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, আমরা কারিগরি সমস্য নিয়ে আলোচনা করেছি। রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে কম আলোচনা হয়েছে। আর আমাদের একটা ধারণা হয়েছে যে, পাঁচ জন নির্বাচন কমিশনার মঙ্গলগ্রহ থেকে এসেছেন, সব কিছুর দায় তাদের। আমরা অন্যায় করবো, আমরা অনিয়ম করবো, আমরা ভোট জালিয়াতি করবো, চুরি করবো, ভোট আনতে দেবো না। কিন্তু ইসিকে কাজটা করতে হবে। এটা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, নির্বাচন করে জনগণ। কিন্তু জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকার, ইসি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তারা সহায়তা না করলে সম্ভব না। আপনাদের নির্বাচন করার যেমন মানসিকতা থাকতে হবে, তেমনই নির্বাচন না করার মানসিকতাও থাকতে হবে। আপনাদের বিবেচনায় তদন্তে যদি মনে করেন, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় তাহলে নির্বাচন থেকে সরে আসা উচিত, আপনাদের পদত্যাগ করা উচিত। বিগত ইসিকেও একই কথা বলেছিলাম। নির্বাচন মানেই বাছাইয়ে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা। সেটা না থাকার যথেষ্ট পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো জিততে চাওয়া। সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় হিসেবে যে শক্তি আসবে আমরা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো। কিন্তু আমরা সেই শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। সবগুলোর প্রার্থী একই মঞ্চে প্রচার করবে এমন ব্যবস্থা করতে হবে। এতে কালো টাকার প্রভাব কমবে।
তিনি আরও বলেন, কিছু দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করার প্রস্তুতি চলছে। একটি পক্ষকে নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়ার কথা চলছে। ঐকমত্য কমিশনে ৩০টি দলের সঙ্গে কথা হচ্ছে। সেখান থেকেও কেউ যদি বলে নির্বাচনে যাবে তাহলে পরিস্থিতি কী হবে, সে বিষয়টা ভাবতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সেরা নির্বাচন হবে। তাহলে কাউকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে সেরা নির্বাচন কীভাবে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ৫৫ বছর পরও নারীদের জন্য মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ আসনের কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের ন্যূনতম দাবি, ৩৩ শতাংশ আসন নারীদের জন্য নিশ্চিত করা। এছাড়া প্রবাসীদের সন্তানরা পড়াশোনার জন্য দেশে থাকে। তাদের নিরাপত্তা ও অংশগ্রহণও গুরুত্ব দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাছে একটা অনুরোধ…সত্যি যদি আপনারা চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন তাহলে সফল হতে পারবেন। পুরো জাতি কিন্তু তাকিয়ে আছে নির্বাচন কমিশনের দিকে। তাই নির্বাচন কমিশনকে স্বচ্ছ হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ভোটার তালিকা বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। গণমাধ্যমকে অবাধ করে দিতে হবে যতটা পারা যায়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষককে যত পারেন যুক্ত করতে হবে। প্রান্তিক নারীদের ও মাইনোরিটিদের এমপাওয়ার করতে হবে।
সব আসনে ‘না’ ভোটের কথা উল্লেখ করে টিআইবি পরিচালক মোহাম্মদ বদিউজ্জামান বলেন, মনোনয়নপত্র দাখিল ও হলফনামায় তারা (প্রার্থী) যা দেয় তাই; এসব তথ্যের যাচাই-বাছাই করার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সিস্টেম আমাদের নাই। আমার মনে হয়, এটা আমাদের যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, না ভোটের ব্যবস্থা যেন সব আসনেই থাকে। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী কোনও আসনে একজন প্রার্থী থাকলে তাকে না ভোটের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে।
বিজিএমইএ পরিচালক রশিদ আহমেদ হোসাইনি বলেন, আপনাদের এই সংলাপ যেন সংলাপ হয়েই না থাকে। আমরা চাইবো, সুন্দর সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করবেন। শুধু ঋণ খেলাপিদের না, যারা অর্থ পাচারকারী তারাও যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সেই আইন করতে হবে।
পুলিশ রিফর্ম কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ হারুন চৌধুরী বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে নিরাপত্তা যেন ভোটাররা পায়, তা এখনই দৃশ্যমান করতে হবে। অনেক প্রার্থী পোলিং এজেন্ট দিতে পারে না। বড় দলগুলো ভয়ভীতি দেখায়। এটা যেন না হয় তা কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন সমাপনি বক্তব্যে বলেন, আমরা নির্বাচনকে স্বচ্ছ করতে চাই। সবাই যাতে দেখতে পারে সে ব্যবস্থা করতে চাই। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের স্বাগতম জানাবো। দেশিয় পর্যবেক্ষক যতটা পারি বেশি নিবন্ধন দিতে চাই। আমরা চেষ্টা করবো আপনাদের পরামর্শ বাস্তবায়ন করাবো। অতীতের মতো হবে না। অনিয়ম হলে আমরা পুরো আসনের নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা ফিরিয়ে এনেছি।
নির্বাচনি এই সংলাপে সভাপতিত্বে করছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন। এছাড়া অন্য চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদসহ ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই সংলাপে সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী প্রতিনিধির ১৪ জন অংশ নেন। আমন্ত্রিতদের মধ্যে আরও ছিলেন– জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আল মাহমুদ হাসানউজ্জামান, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মো. মাহফুজুর রহমান, অধ্যাপক আব্দুল ওয়াজেদ, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি জারিফ রহমান প্রমুখ।
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোটের লক্ষ্য নিয়ে সব প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে ইসি। অক্টোবরজুড়েই রাজনৈতিক দল, নারী নেত্রী, জুলাই যোদ্ধা, গণমাধ্যমের সঙ্গে সংলাপে বসবে ইসি।