জাতীয় ডেস্ক :
স্থানীয় প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ভারতের মেঘালয় দিয়ে নেমে আসা নেত্রকোনার কলমাকান্দা সীমান্তের মহাদেও নদ থেকে অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে প্রভাবশালীরা। এতে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। হুমকিতে তীরবর্তী কয়েক শতাধিক আদিবাসী পরিবারসহ সীমান্তের বাঙালি জনগোষ্ঠী। এরই মধ্যে ভিটা ছেড়েছেন অনেকে। নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক। প্রতিকার চেয়ে মানববন্ধন করায় জীবননাশের হুমকিতে স্থানীয়রা।
সরেজমিন দেখা গেছে, পাহাড়-নদীর গভীর মিতালি নেত্রকোনার কলমাকান্দা সীমান্তের পাতলাবন এলাকাটি। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর হয়ে আদিবাসী বাঙালিসহ বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে এসেছে মহাদেও নদ। কলমাকন্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের মনকাড়া সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি বড়ুয়াকোনা সীমান্তের সন্ন্যাসী পাড়া, পাতলা বন।
দেখে মনে হবে নীলগিরির মতো মেঘ যেন উড়ে যাচ্ছে। মহাদেও নদের ঠিক মাথার ওপরই এমন সৌন্দর্য। নয়নাভিরাম এই সৌন্দর্য মন কাড়ে যে কারোর। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই এ নদের সৌন্দর্য বিনষ্ট করে যাচ্ছে সরকারদলীয় প্রভাবশালীরা। ঘরবাড়ি হারাচ্ছে নদীতীরবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী অসংখ্য আদিবাসী পরিবারসহ বাঙালিরা। কেউ কেউ আশ্রয় নিচ্ছেন অন্য বাড়িতে।
পাহাড়ি ঝরনাধারার মহাদেও নদের বিশাউতি, হাসানগাঁও ও ওমরগাঁও তিনটি স্থানের অংশে শুধু বালু উত্তোলনে সরকারিভাবে ইজারা দেয়া হলেও এর থেকে আরও তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরে সন্ন্যাসীপাড়া পাতলাবন সীমান্ত এলাকায় নদের উৎপত্তিস্থলেই গিয়ে করছে অবৈধ উত্তোলন। ভারত-বাংলাদেশ সীমানা থেকেই হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ড্রেজার মেশিনে দিনরাতে অবাধে তোলা হচ্ছে পাথর ও বালু, যা পরিবহন করতে দুর্ঘটনার পাশাপাশি নষ্ট হয়েছে গ্রামীণ সড়কও।
মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে পরিবেশ। পাহাড়ি ঢলে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র ভাঙন। এ অবস্থায় প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও শব্দদূষণের প্রতিবাদ করলেও উল্টো প্রভাবশালীদের হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন আদিবাসীসহ স্থানীয়রা। ভিটেমাটি হারানোর ফলে পরিবেশ রক্ষায় পাথর উত্তোলন বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করলে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীকে করছে মারধর। দিচ্ছে প্রাণনাশের হুমকিও।
এসব খবরে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থেকে একটি পরিদর্শন টিম এরই মধ্যে নেত্রকোনা পরিদর্শন করে নদী রক্ষা জেলা উপজেলা কমিটির সঙ্গে বিশেষ সভা করেছে। এদিকে এমন নৈরাজ্য বন্ধে জেলা প্রশাসন থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি স্থানীয়রা নৈরাজ্যের প্রতিবাদে সীমান্ত এলাকায় প্রতিবাদ করতে গেলেও স্থানীয় সংসদ সদস্যের শ্বশুরবাড়ির চয়ন বিশ্বাসসহ যুবলীগের নেতাকর্মীরা গিয়ে তাদের হুমকি দিয়ে ব্যানার ছিনিয়ে নিয়ে তাড়িয়ে দেয়। এ সময় উপজেলা যুবলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক চয়ন বিশ্বাস নিজের পরিচয় তুলে ধরে সাংবাদিকদের বলেন সবটাই ইজারাকৃত। এতে বেশ কয়েকজনের কর্মসংস্থান হয়েছে। যে কারণে আদিবাসীসহ অন্যরা সহ্য করতে পারছে না।
তবে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন (ইউএনও) আবুল হাশেম জানান, বিশাউতি, হাসানগাঁও ও ওমরগাঁও তিনটি স্থানের অংশ তারা ইজারা দিয়েছেন। পাতলাবন সন্ন্যাসীপাড়া কোনোটাই ইজারাকৃত নয়।
তিনি জানান, সরকারের রাজস্ব শাখা থেকে গত বছর ৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকায় মহাদেও নদের বিশাউতি, হাসানগাঁও, ওমরগাঁও তিন স্থানের ৩৫ দশমিক ১৫ একর জায়গা বালুমহাল ইজারা দিলেও এ বছর ৭২ লাখ ২ হাজার টাকায় ইজারা নেন জনৈক চানমিয়া। চানমিয়ার অন্য পরিচয় না জানলেও তার সাং দুর্গাপুর লেখা বলে জানান তিনি।
এদিকে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। আমরা খবর পেয়েই সেখানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করছি। এ পর্যন্ত ১৫ বার মোবাইল কোর্ট করা হয়েছে। বিজিবিকে চিঠি দিয়েছি। পাথরও জব্দ করেছি।’
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উপপরিচারক (প্রশাসন ও অর্থ) খ.ম. কবিরুল ইসলাম বলেন, ‘পরিদর্শন শুরু করেছি। প্রাথমিকভাবে অবৈধ এই কাজ বন্ধ করার অনুরোধ করে যাচ্ছি স্থানীয় প্রশাসনকে। আমি জানতে পেরেছি, আমি আসার আগের দিন রাতেও এখানে পাথর-বালু তোলা হয়েছে। আমাদের আসার খবর পেয়েই তারা সরিয়ে নিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি নদীগুলো সার্ভে করতে হবে। প্রয়োজন হলে ইজারা বন্ধ করে দেয়া হবে। প্রয়োজন হলে অন্যদিকে ইজারা হবে।’