হোম আন্তর্জাতিক আমেরিকা প্রবাসী করোনা আক্রান্ত রোগীর দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা

আমেরিকা প্রবাসী করোনা আক্রান্ত রোগীর দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা

কর্তৃক
০ মন্তব্য 139 ভিউজ

অনলাইন ডেস্ক :

আজ ১৪ তম দিন পার করছি, প্রথম যে দিন থেকে কাশি শুরু হল ভাবলাম সাধারণ কাশি, দ্বিতীয় দিন ভাল, তৃতীয় দিন আবার। একটু সিরিয়াসলি নিলাম, ঠান্ডা পানি খাওয়া বাদ দিলাম, ভিটামিন- সি যোগ করলাম,আদা,লেবু, দারুচিনি লবঙ্গ সব কিছু পানীয়ে মেশাতে শুরু করলাম, কালিজিরার ভর্তা, মধু কিন্তু কিছুতেই কাশির পরিবর্তন হল না।

৬ দিন পর বন্ধু স্বপন ভাইয়ের পরামর্শে রসুন সেদ্ধ করে খাওয়ার পর প্রচন্ড জ্ব্রর অনুভব করলাম,পরিমাপ করার জন্য thermometer খুঁজতে গিয়ে পেলাম না, ছেলে মেয়েকে পাঠালাম কিনতে, সারা এলাকা খোঁজাখুঁজি করে ওরা ফিরে এল কোথাও নেই, স্বার্থপর ক্রয়ের কারণে Run out. অনলাইনে খুঁজে দেখি সবচে কাছের ডেলিভারির সময় ৫ই এপ্রিল l পরিচিত অনেককে ফোন করলাম সবাই বলে নেই ।

সময়,পরিবেশ এবং পরিস্থিতি সবই যেন বিদ্রূপ শুরু করে দিল। General practitioner এ কল দিলাম ওরা কিছু পরামর্শ দিয়ে প্রয়োজনে NHS 111 এ কল দিতে পরামর্শ দিল। কি এক দুর্বিসহ যন্ত্রণা সেটা ভাষায় ব্যাখ্যা করা অসম্ভব, দাড়াতে পারি না শুয়ে ভাল লাগে না, কাশির সাথে নাড়িভুঁড়ি বেড়িয়ে আসতে চায়। মাথার খুলিটা যেন ফাঁপা একটা শক্ত বলয় যার ভেতর একটা পিংপং বল এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়ালে ড্রিবলিং করছে। ঘুমের মাঝে প্রচন্ড পিপাসা পানি পানেও নিবারণ হয় না, প্রতি মুহূর্তে পিপাসা আর চোখে ঘুম সে এক আসহনীয় যন্ত্রণা।

৯ম দিনে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করতে যেয়ে দেখি মুখে স্বাদ নাই আর নাকে খাবারের গন্ধ নাই। এক টুকরো আদা মুখে দিলাম কিন্তু এটা কি আদা না মাটির টুকরা স্বাদ গন্ধ কিছুই পেলাম না। কাশির সাথে রক্ত আসতে শুরু করল আর এটাই আমার আত্মবিশ্বাসের দেয়ালে প্রথম আঘাত।

কাউকে না জানালেও সবার কাছ থেকে কথার ছলে মাফ চেয়ে নিতে থাকলাম, ছেলেমেয়েদের কাছে ডেকে ওয়াসিয়ত করা শুরু করলাম আমার অনুপস্থিতিতে কিভাবে থাকতে হবে, কোথায় কি রাখা আছে। নিউজার্সিতে মাকে জানালাম শুনে তো তার সে কান্না, সবাইকে একসাথে করে ফেললেন, যারা জানে অথবা না জানে। ১১ত ম দিনে,হ্যাঁ করোনা ভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে প্রথম ভয়ে ভয়ে যখন NHS এ কল দিলাম ভাবলাম ওরা হয়ত আমাকে নিয়ে যাবে।

ছেলে মেয়ে দুটোর কথা ভেবে অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্বে সিদ্ধান্ত নিতে একটু দেড়ি হল যাহোক, কথা শেষে ও প্রান্ত থেকে বলা হল যতসম্ভব তাড়াতাড়ি COVID -19 Team কল ব্যক করবে ২/৩ ঘণ্টা লাগতে পারে কারণ কল লিস্ট লম্বা লাইন, সংখ্য অনেক। ইতিমধ্যে আমি যেন GP তে কল দেই মেডিসিন এর জন্য, আমাকে আর কল করতে হল না ১০ মিনিটের মধ্যে ওরাই কল করল, সব শুনে ডাক্তার বললেন symptoms এ মনে হয় mild attack, ১১তম দিন সময়টা Crucial কাশির সাথে রক্ত আসে শুনে Amoxicillin 500mg prescribe করে নিকটস্থ ফরমাশির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়ে, ওখান থেকে ঔষধ সংগ্রহ করতে বললেন এবং জোড় করে খুব অল্প করে খাওয়া চালু রাখতে বললেন আস্তে আস্তে রুচি ফিরে আসবে।

ছেলেকে পাঠিয়ে ঔষধ সংগ্রহ করলাম আর অপেক্ষা করতে থাকলাম Covid teamএর কল এর জন্য, সময় যায় ১,২ করে ৩ ঘণ্টা এর মাঝে নুতন লক্ষণ যুক্ত হতে লাগল নাকে রক্ত, মেয়ে আবার কল দিল 111 এ ওরা দুঃখ প্রকাশ করে অপেক্ষা করতে বলল ৫ ঘণ্টা পর যোগ হল ডায়রিয়া আবার কল করলাম সেই একই কথা।

আশা বাদ দিয়ে আল্লাহর নাম জপতে জপতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম ঘুম ভাঙল ওদের কল পেয়ে, ওপার থেকে প্রথমেই ক্ষমা প্রার্থনা অনিচ্ছাকৃত দেরির জন্য। তারপর প্রশ্ন কিভাবে সাহায্য করতে পারে? সব শুনল তারপর বলল তুমি কেমন অনুভব কর? বললে কিছুক্ষণের মধ্যেই এম্বুলেন্স আসবে। ইতিমধ্যে আমার খারাপ লাগাটা অনেকটা কমে এসেছে হয়ত একটু ঘুমের কারণে।

হাসপাতালে যেতে আমার মন চাচ্ছিল না কিন্তু মনে মনেই রাখলাম জিজ্ঞেস করলাম বাসায় থেকে Test করানো যায় কিনা? উত্তরে বলেন এখন শুধু যারা হাসপাতালে recovery হয় তাদেরকেই শুধুমাত্র test করা হয়, হয়ত আগামী সপ্তাহ থেকে ব্যাপক পরিক্ষা শুরু করা হবে। আমি আবার প্রশ্ন করলাম এম্বুল্যান্স কি আমাকে হাসপাতালে নিয়েই যাবে? উত্তরে বলল তারা আসবে দেখবে তারপর সিদ্ধান্ত নিবে It depends on your situation, তবে তুমি একটু ভেবে ৯৯৯ কল দাও তোমার ব্যপারে নোট দেয়া আছে ওরা চলে আসবে।

বললাম আচ্ছা আমি ভেবে কল দেই বলে ফোন রাখলাম। মেয়েটা পাশেই ছিল বলল, আব্বু হাসপাতালের সিস্টেম এখন আর স্বাভাবিক নাই আর এ ব্যপারে তোমাকে তারা অক্সিজেন ছাড়া কি চিকিৎসা দিবে? ১২ দিন হল এখন কোথায় তোমাকে নিয়ে যাবে আবার নুতন করে আইসোলেশনে রাখবে, তোমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না, এন্টিবায়োটিক আছে, আমি সেবা করব যদি আরো খারাপের দিকে যায় তখন যেও ওরাতো বললই।

কথাটা ভালই লাগল আর সবচে বড় ভরসা পেলাম এই ভেবে যে, যে কোন সময়ই কল করলে ওরা আসবে এই ভরসাটাই আমায় মনে অনেক সাহস এলো, ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গেলাম ঘুম ভাঙল ফোনের আওয়াজে NHS এর সেই ভদ্রমহিলা জানতে চাচ্ছেন আমার সিদ্ধান্ত, আমি বললাম আমি কি আরো সময় নিতে পারব? তিনি বললেন অবশ্যই যদি তোমার শ্বাসকষ্ট না থাকে আমি সাজেস্ট করব বাসায় থাক যতক্ষণ সহ্য করতে পার, আর তাছাড়া এন্টিবায়োটিক কাজ করতে অন্তত: ২ দিনতো লাগবেই।

খারাপের দিকে গেলে যেকোন সময় ৯৯৯ এ কল দিবে। ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে ঘুমিয়ে গেলাম। ১৩ তম সকালে যখন ঘুম থকে উঠলাম সে কি কাশি দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত কিন্তু খুদা আর খাবারের স্বাদ গন্ধ ফিরে আসতে লাগলো, এ যেন বাঁচার নতুন আশা। কাশিটা সারাদিন ছিল, বিকেলে ছোট ভাই Birmingham থেকে ফোন করে জানতে চাইল কেমন আছি, কাশির কথা বললাম ও বলল ভাই আমার ২ কলিঙের হয়েছিল শেষ ৩ দিন খুব খারাপ গেছে। আমিও আর ভাবি না, খেতে যখন পারি আর সমস্যা নাই।

আজ ১৪ তম দিন প্রচন্ড খুদা নিয়ে উঠলাম, নাস্তা খেলাম দুপুরের জন্য নিজেই পাতলা ভেজিটেবল খিচুড়ি রান্না করলাম। দুপুরে খেতে বসে যখন ২য় প্লেট খাবার নিলাম মেয়েটা দেখি হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলছে মাশাল্লাহ! অর্থাৎ ও দেখেছে এই ১৩ টা দিন কোন সলিড খাবার আমি দেখতেই পারতাম না। বেচে ছিলাম শুধু অরেঞ্জ জুস, দুধ আর গরম পানির উপর। কোনদিন খাবারের স্বাদ ফিরে পাব বিশ্বাস হয়নি। নাক দিয়ে রক্ত এখনো বন্ধ হয়নি। এখন একটাই ভয় ছেলে মেয়ে দুইজনে যদি সংক্রামিত হয়ে ।

 

ফেসবুক থেকে সংগৃহীত ।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন