রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী :
দিন তারিখ মনে নেই। বসেছিলাম পুলিশ সুপারের অফিসে। তৎকালীন সময় পুলিশ সুপারের দায়িত্বে ছিলেন আব্দুর রহিম। আমি ছিলাম যুগান্তর পত্রিকায় কর্মরত। দুজনে কথা বলছিলাম। হঠাৎ সাদা পোশাকে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন পুলিশ সুপারের অফিসে। এসপি সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে ওই ভদ্রলোককে সম্মান জানালেন। ভদ্রলোকের মুখখানা চেনা চেনা মনে হল। এসপি সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন। তিনি একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা। এই মামলার বিষয়ে তিনি দুই একবার টেলিভিশনে বাইট দিয়েছেন। সে কারণেই তার মুখখানা ছিল চেনা চেনা। পরিচয়পর্ব শেষ হতেই সিআইডি বিশেষ পুলিশ সুপার কে বলেছিলাম, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জজ মিয়ার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়না। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে মনে হয়েছিল, জজ মিয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ছিল মেকিং। আমার মুখ থেকে এ কথা শুনেই সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মিস্টার রুহুল আমিন সাহেব তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। তার সাথে তর্ক যুদ্ধে লিপ্ত হলাম।
পরিচয় পর্বের সময় নাম বলেছিলাম । তিনি আরেকবার নামটা জানতে চাইলেন। বললাম। কিছুটা ক্ষিপ্র কণ্ঠে বললেন, আপনারা জজ মিয়ার স্বীকারোক্তি বিশ্বাস করবেন কিভাবে ? কারণ ভারত থেকে এসেছে আর্জেস গ্রেনেডের চালান। ভোমরা সীমান্ত দিয়ে এই গ্রেনেডের চালান বাংলাদেশ ঢুকেছে, যা একুশে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ব্যবহৃত হয়েছে। জজ মিয়ার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী রাজধানীর কুড়িল থেকে মুকুল নামের এক টোকাই কে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে সিআইডি পুলিশ। আর এই টোকাই মুকুলের বাড়ি সাতক্ষীরা শহরতলীর কাশেমপুর গ্রামে। মুকুলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনি গ্রেনেড এর রুট খুঁজতে সাতক্ষীরায় এসেছেন। কিছুটা দাম্ভিকতার সাথে তিনি বললেন, আমার প্রতিনিয়ত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সাথে কথা হচ্ছে। তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুর রহিম সাহেব আমাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন। শান্ত হলাম।
সালাম দিয়ে পুলিশ সুপারের অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই মানবজমিন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হলো “সিআইডির টাকায় চলে জজ মিয়ার সংসার”। হাটে হাড়ি ভেঙে গেল। কারো বুঝতে অসুবিধা হলো না একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জজ মিয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ছিল সিআইডি পুলিশের সাজানো নাটক।
থমকে গেল শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত কার্যক্রম। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শেখ হাসিনার সমাবেশে ঘটেছিল বর্বোরোচিত এই হত্যাযজ্ঞ।
বছর গড়িয়ে গেল। ২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট দেশজুড়ে বোমা হামলা চালানো হলো। সিরিজ বোমা হামলার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সাতক্ষীরায় একজন পকেটমারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী জেএমবি জঙ্গি গোষ্টিকে সনাক্ত করা সম্ভব হল। তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় জেএমবির জঙ্গিগোষ্ঠীকে আড়াল করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দেশী-বিদেশী চাপে বিএনপি’র চারদলীয় জোট সরকার জেএমবির জঙ্গিগোষ্ঠীকে আড়াল করতে পারেনি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলো। দেশে জারি হল জরুরি অবস্থা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত কার্যক্রমে প্রাণ ফিরে পেল। সিআইডি পুলিশেরই তদন্তে ফেঁসে গেলেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন ও সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান। জজ মিয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সাজানো বলে প্রমাণিত হলো। চারদলীয় জোট সরকারের কয়েকজন শীর্ষ নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষকতায় হরকাতুল জিহাদ একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল বলে স্পষ্ট হয়ে যায়। তৎকালীন সরকার হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মাওলানা তাজউদ্দীনসহ কয়েকজনকে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়।
কথায় বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। কোন সত্য গোপন থাকে না। একদিন না একদিন তা প্রকাশ পায়। যদি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন না হতো, তাহলে হয়তোবা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি জজ মিয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি অনুযায়ী উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চেপে যেত।
লেখক : সম্পাদক, সংকল্প নিউজ ও আরটিভি প্রতিনিধি