হোম রাজনীতি সিসিতে খুশি আমেরিকা বাংলাদেশের ইসিতে নাখোশ কেন?

সিসিতে খুশি আমেরিকা বাংলাদেশের ইসিতে নাখোশ কেন?

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 103 ভিউজ

রাজনীতি ডেস্ক:

সম্প্রতি দুই মাসের মাথায় দুটি আলোচিত নির্বাচনে আমেরিকার দুই ধরণের আচরণ প্রত্যক্ষ করল বিশ্ববাসী। ২০২৩ সালে ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত মিসরের একতরফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা টু শব্দটি না করলেও বাংলাদেশের নির্বাচনের বেলায় শুরু থেকেই সরব ছিল বাইডেন প্রশাসন।

দেশে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২২২ আসন নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ সরকার। নির্বাচন নিয়ে রাশিয়া, চীন ও ভারত সন্তুষ্টির কথা জানালেও আমেরিকা জানিয়েছে তারা এই নির্বাচনে নাখোশ।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেয়া তথ্যে দেখা যায়, মোট ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল জানান, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৫ লাখ ১ হাজার ৫৮৫ জন। তাদের মধ্যে ৪ কোটি ৯৯ লাখ ৫৫ হাজার ৪৪৫ জন ভোটার ভোট দিয়েছেন।

ভোটের ফলাফল অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২২ আসন, স্বতন্ত্র ৬২ আসন, জাতীয় পার্টি ১১ আসন। ২৯৮ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছে ৭৪ শতাংশ।

ভোট কেন্দ্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক কোনো বিষয়ে অভিযোগ না তুলে আমেরিকা জানিয়েছে, বাংলাদেশের এ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি।

নির্বাচনের পরদিন অর্থাৎ ৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টেমন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কার্যালয় থেকে ইস্যু করা ‘পার্লামেন্টারি ইলেকশনস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক বিবৃতিতে দেশটি জানিয়েছে, নির্বাচনের আগে হাজারের বেশি বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী গ্রেফতার এবং নির্বাচনের দিনে বিভিন্ন জায়গায় নানা ধরণের অনিয়মের খবরে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ২8টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়ার পরেও যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে, সব দল নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় তারা হতাশ। এছাড়া নির্বাচনের সময় এবং এর আগের মাসে বাংলাদেশে যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তা নিন্দনীয়।

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পুরো বছরজুড়ে সরব থাকলেও প্রায় এক মাসের ব্যবধানে ডিসেম্বরে মাঝামাঝিতে মিশরের নির্বাচন এবং সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে একেবারেই নীরব ছিল দেশটি।

মিশরের অঘোষিত একনায়ক হিসেবে পরিচিত আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি টানা তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেছেন। সিসির বিগত শাসনামলে বড় বড় মানবাধিকার সংস্থাগুলো মানবতার বড় বিপর্যয় বলে আখ্যা দিলেও যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে যেকোনো মূল্যে ফাত্তাহকে পুনর্নির্বাচিত করতে চেয়েছে এবং হয়েছেও তাই।

মিশরের নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশটির এবারের নির্বাচনে ভোট পড়েছে মোট ৬৬ দশমিক ৮ শতাংশ এবং সিসি সরকার একাই পেয়েছে ৮৯ দশমিক ৬ শতাংশ।

একদিকে মিশরের অর্থনীতি ধুকছে, অন্যদিকে দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে। এর মধ্যে সিসির এমন বিজয় অনেকটাই পূর্ব নির্ধারিত। নিজের গদি টিকিয়ে রাখতে হেন কিছু নেই যা সিসি করেননি। বিশেষ করে দেশের স্বার্থ ও গণতন্ত্র বিকিয়ে দিয়ে আমেরিকার সঙ্গে আঁতাত সিসিকে আবারও ক্ষমতায় আনতে প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।

মিশরের মানবাধিকার কর্মী হোসেন ভাগত বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘কীসের নির্বাচন কীসের কি! দেশের নিরাপত্তাকর্মী থেকে প্রশাসন সব সিসির হাতে। সে যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই নির্বাচন হয়েছে। এটাকে আদতে কোনো নির্বাচনই বলা যায় না।’

হোসেনের বক্তব্যের সত্যতা লেলে আমেরিকান থিংক ট্যাঙ্ক ক্যাটো ইন্সটিটিউটের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে। জুলাইয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ক্যাটো জানিয়েছে, দশ বছরের বেশি সময় ধরে সিসির নেতৃত্বে মিশরে চলছে একনায়কতন্ত্র এবং অরাজকতা। কিন্তু আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অবস্থান ও স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে এই একনায়কতন্ত্রকে বছরের পর বছর ধরে সমর্থন দিয়ে আসছে।

মধ্যপ্রাচ্যের ক্যান্সার নামে খ্যাত ইসরাইলের আধিপত্যকে টিকিয়ে রাখতে টাকা দিয়ে মিশরকে পুষছে আমেরিকা। ১৯৭৮ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির আওতায় মিশর সরকারকে প্রতিবছর ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার করে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার।

শুরুতে বাইডেন প্রশাসন এই সহায়তা বন্ধের কথা জানালেও, বিগত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান খারাপ হতে শুরু করলে সে পথে আর হাঁটেনি আমেরিকা।

এর আগে মিশরের আরেক একনায়ক হোসনি মোবারককে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সমর্থন দিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। সিসি যদি গণতন্ত্রের পথে হাঁটতো তাহলে তাকে সমর্থন দিয়ে আমেরিকার কোনো লাভ হতো না। কিন্তু সিসিও যখন একনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে আমেরিকার তাবেদারি শুরু করে তখন তার মানবাধিকার বহির্ভূত সব কার্যক্রমে নীরব সম্মতি দিয়ে আসছে দেশটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলত মিশরের মানুষ চায় দেশটি সরাসরি ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াক। লিবিয়া ও সিরিয়ার মতো দেশগুলোকে সাহায্য করুক। কিন্তু সিসি সরকার আমেরিকার হাতের পুতুল হয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের স্বার্থ না দেখে ইসরাইলকে টিকিয়ে রেখে আমেরিকার স্বার্থ দেখছে। তাই নির্বাচনের মাধ্যমে হোক বা অন্য কোনো মাধ্যমে; আমেরিকার সিসিকে সমর্থন দেয়ার কারণ বুঝতে আর কিছু বাকি থাকে না।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমেরিকার এই নাখোশ হওয়ার কারণও একই ইতিহাসে স্পষ্ট। মূলত ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, চীন-রাশিয়ার সঙ্গে ভালো কূটনৈতিক সম্পর্কের বেড়াজালে কোনোভাবে আমেরিকা বাংলাদেশের সঙ্গে পেরে উঠছিল না।

এবারের নির্বাচনে চাপ প্রয়োগ করে আমেরিকা কী অর্জন করতে চাচ্ছে তার ইঙ্গিত মেলে প্রধান শেখ হাসিনার বক্তব্যে।

গত বছর জুন মাসের এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপ কাউকে লিজ দিলে ক্ষমতায় থাকতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু আমার দ্বারা সেটা হবে না। দেশের সম্পদ বিক্রি করে আমি ক্ষমতায় থাকতে চাই না।

সেসময়ে প্রধানমন্ত্রী নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেন, ‌‘২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল কীভাবে? তখন তো গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিল। তাহলে এখন তারা দেশ বিক্রি করবে? নাকি সেন্টমার্টিন দ্বীপ বিক্রি করার মুচলেকা দিয়ে আসতে চায়? আমি তো এইটুকু বলতে পারি, আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা, আমার হাত দিয়ে এই দেশের কোনো সম্পদ কারও কাছে বিক্রি করে আমি ক্ষমতায় আসতে চাই না। ওই গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিলে আমিও ক্ষমতায় থাকতে পারতাম। এখনও যদি বলি ওই সেন্টমার্টিন দ্বীপ বা আমাদের দেশ লিজ দেব, তাহলে আমার ক্ষমতায় থাকার কোনও অসুবিধা নেই। আমি জানি সেটা। কিন্তু আমার দ্বারা সেটা হবে না।’

এর আগে একই মাসে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন জাতীয় সংসদে এক বক্তব্যে বলেন, ‌‘যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন চায়, কোয়াডে বাংলাদেশকে চায়। বাংলাদেশকে তারা বাগে রাখতে এর আগে স্যাংশন দিয়েছে। এখন নির্বাচনকে উপলক্ষ করে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। এটা শুধু দুরভিসন্ধিমূলকই নয়, তাদের রেজিম চেঞ্জের কৌশলের অংশ।’

বিখ্যাত আমেরিকান দার্শনিক নোয়াম চমস্কি দেশটির রাজনৈতিক স্বভাব উল্লেখ করে তার বিভিন্ন গ্রন্থে বলেন, আমেরিকার সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক বন্ধুভাবাপন্ন মানে সেখানে দেয়া-নেয়ার একটা নিবিড় সম্পর্ক থাকতে হবে। এই সম্পর্কে ভাটা পড়লে এবং আমেরিকা যখন বুঝতে পারবে এখানে তাদের মুনাফা করার কিছু নেই তখনই বেঁকে বসবে।’

আমেরিকার গণতন্ত্র রক্ষা আর সন্ত্রাসবাদ দমন বিশ্ববাসীকে চোখে ধূলা দেয়া ছাড়া আর কিছু না উল্লেখ করে আফগানিস্তান প্রসঙ্গে চমস্কি আর এক প্রবন্ধে বলেন, তালেবানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক খারাপ হয় ওসামা বিন লাদেনকে নিয়ে। ওসামা যখন আর আমেরিকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করেনি তখনই তারা তালেবানদের সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করতে থাকে। ওসামা যদি আমেরিকার তাবেদারি বজায় রাখতো, তখন সে যেই কর্মকাণ্ডই করুক না কেন, তার ছাড়পত্র বিনা দ্বিধায় আমেরিকা দিয়ে দিত।

ঔপনিবেশিক যুগের পর উত্তর উপনিবেশিকতাবাদ বা মূলত সাম্রাজ্যবাদ নামে পরিচিত তা আমেরিকার হাত ধরেই শুরু। এককালে যেভাবে ব্রিটেন বা ফ্রান্সের মতো দেশগুলো সভ্যতার আলো ছড়ানোর নাম করে সারা বিশ্বে নিজেদের দখলদারিত্বকে টিকিয়ে রেখেছিল, সেভাবে এখন আমেরিকা গণতন্ত্র রক্ষা ও সন্ত্রাসবাদ দমনের নাম করে দেশে দেশে সার্বভৌমত্বকে শঙ্কার মধ্যে ফেলছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

যে আমেরিকা গণতন্ত্রের নাম জপতে জপতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে সেই আমেরিকার গণতন্ত্র নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম এল পাইসের এক সাক্ষাৎকারে চমস্কি বলেন, আমেরিকার নিজ দেশের গণতন্ত্র ভয়াবহ বিপদের মুখে আছে। ট্রাম্পের উগ্রবাদের বিশাল বড় সমর্থক থেকে শুরু করে ইউএস ক্যাপিটালের হামলা; সবকিছুই আমেরিকার গণতন্ত্রের ভঙ্গুরতা প্রমাণ করে।

আরেক সাক্ষাৎকারে চমস্কি বলেন, আমেরিকার স্বভাব অন্য সবাইকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করা। এটি সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়েছে এবারের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে। এই যুদ্ধের আঁচ যাতে সরাসরি আমেরিকার গায়ে না লাগে তাই তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে ইউরোপকে। এতে করে ইউরোপের অর্থনীতিতে ধস নেমেছে, আর আমেরিকা ছিল এক রকমের বহাল তবিয়তে। ইউরোপ আমেরিকাকে না ছাড়লে তাদের পতন অনিবার্য বলে উল্লেখ করেন চমস্কি।

কূটনীতির বাজারে সবচেয়ে প্রচলিত কথা হচ্ছে, আমেরিকা যার বন্ধু আলাদা করে তার আর শত্রুর প্রয়োজন নেই। এর চাক্ষুষ প্রমাণ পাকিস্তানের বর্তমান বিপর্যয়। বলা হচ্ছে, আগামীতে মিশরকে অন্ধকারে ঠেলে দেবে এই শক্তিধর দেশটি।

এদিকে আমেরিকার রক্তচক্ষু পাত্তা না দিয়ে বাংলাদেশের এই এগিয়ে চলা গায়ে কাঁটার মতো বিধঁছে বাইডেন প্রশাসনের। আর তাইতো সিসির নির্বাচনে খুশী থাকলেও বাংলাদেশের ইসির প্রকাশিত ফলাফল নিয়ে নাখোশ আমেরিকা।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন