হোম খুলনাযশোর সাব রেজিস্ট্রার ইকবাল ও পিয়ন মুকুটের ঘুষ লেনদেন ওপেন সিক্রেট

সাব রেজিস্ট্রার ইকবাল ও পিয়ন মুকুটের ঘুষ লেনদেন ওপেন সিক্রেট

কর্তৃক Editor
০ মন্তব্য 59 ভিউজ

বি এম ফারুক,:
যশোরের অভয়নগর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস অনিয়ম-দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। ঘুষের লেনদেন চলে এখানে এক প্রকার ওপেন সিক্রেটে। এখানে দলিল লেখক, স্ট্যাম্প ভেন্ডার ও পতিত স্বৈরাচারের দোসরা মিলে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন এখানে আসা সেবা প্রত্যাশীরা। আর এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব রয়েছেন সাব রেজিস্ট্রার ইকবাল হুসাইন। তার কথায় অফিসের পিয়ন মুকুট সব ধরণের লেনদেন করছেন।
সূত্র জানায়, জমির নিবন্ধন, নামজারি, জাল দলিলে জমি দখলসহ নানা ঘটনায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন ভুক্তভোগীরা। জমির দলিল আটকে রেখে ভুক্তভোগীদের চাপের মুখে ঘুষ দাবি সাব-রেজিস্ট্রার, উম্মেদার, পিওন ও নকলনবিশদের নিয়মিত আচরণে পরিণত হয়েছে। ঘুষ আদায়ের কৌশল হিসেবে সাব-রেজিস্ট্রারের রুটিনমাফিক কাজ নকলনবিশ, উম্মেদার ও পিওন দিয়েও করানো হচ্ছে। এই সুযোগে নকলনবিশ, উম্মেদার ও পিওন লাখ লাখ টাকার মলিক হচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন ম্যানুয়াল-২০১৪ মানছেন না সাব-রেজিস্ট্রার ইকবাল হুসাইন। তিনি নিবন্ধন ম্যানুয়াল অনুযায়ী নিজের কাজ নকলনবিশ, উম্মেদার ও পিওনদের দিয়ে করাচ্ছেন। দলিল চেক করার কাজ সাব-রেজিস্ট্রারদের করার নিয়ম থাকলেও তা মানছেন না তিনি। অনুসন্ধানে ও সরেজমিন এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সূত্র মতে, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন ম্যানুয়াল-২০১৪-এর অধ্যায়-২৬-এ উল্লেখ আছে যে, সহকারীগণ কর্তৃক দলিল পরীক্ষাকরণ কাঙ্খিত নয়, এই কাজটি অবশ্যই স্বয়ং নিবন্ধনকারী কর্মকর্তা কর্তৃক সম্পাদিত হবে। এ নিয়েম থোড়ায় তোয়াক্কা করে চলেছেন সাব রেজিস্ট্রার ইকবাল হুসাইন। তিনি উপরি আয়ের জন্য কাজ বুঝে টাকা দাবি করছেন। টাকা না দিলে নানা রকম টালবাহোনা করছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
জানা গেছে, সাধারণত জমি ক্রয় করতে গেলে গ্রহীতা ও দাতার ন্যাশনাল আইডি, ছবি, জমির পর্চা, দাখিলা ও দলিল অতি প্রয়োজন। রেজিস্ট্রি অফিসে ১০ লাখ টাকা ক্রয় মূল্যের একটা দলিলে সরকারি ফি ব্যাংকে জমা দিতে হয়। পিয়ন মুকুটকে দিতে হয় প্রতি লাখে ৩ হাজার টাকা। ইউপি ভ্যাট দিতে হয় প্রতি লাখে ১ হাজার টাকা করে। আর ফি বাবদ দিতে হয় প্রতি হাজার ১০ টাকা করে। স্ট্যাম্প বাবদ দিতে হয় প্রতি লাখে দেড় হাজার টাকা। সমিতিতে দিতে হয় দলিল প্রতি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা করে। প্রতিদিন গড়ে এই অফিসে ৪০ থেকে ৫০টি দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে থাকে। সেই অর্থে প্রতি মাসে এই অফিসে কোটি টাকা অবৈধ লেনদেন হয়। এর বড় অংশ নেন সাব রেজিস্ট্রার ইকবাল হুসাইন। বাকী টাকা পিয়ন মুকুট মকলের মাঝে ভাগ করে দেন।
জানা যায়, দলিলের ফি ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করলেও শেরেস্তা (অতিরিক্ত ফি) ছাড়া কোনো দলিল রেজিস্ট্রি হয় না এখানে। পিয়ন মুকুট কাগজপত্র চেক করে দেবার পর সাব রেজিস্ট্রারের সাথে আলাপ আলোচনা করেন। সাব রেজিস্ট্রার ইকবাল ঘুষের রেট নির্ধারণ করে দেন। চাহিদা মোতাবেক টাকা না পেলে বিভিন্ন কাগজপত্রের অজুহাতে হয়রানি করা হয়। আবার টাকা পেলেই সব বৈধ হয়ে যায়। আবার মোটা অংকের টাকা পেলে অবৈধ্য কাগজপত্র তিনি বৈধ্যতা দিয়ে দলিল রেজিস্ট্রেশন করে থাকেন। সম্প্রতি ঘুষ কেলেংকারী ছাড়াও শ্রেনি পরিবর্তন করে জমি রেজিস্ট্রি করার ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এখানে শ্রেনী পরিবর্তন করে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে প্রায় লক্ষাধিক টাকা। আর এ কাজে জড়িত রয়েছে দলির লেখক মফিজুর রহমান, পিয়ন মুকুট ও সাব রেজিস্টার ইকবাল হুসাইন। সম্প্রতি ঘুষের লেনদেনের ছবি ভাইরাল হয়েছে।
সূত্র জানায়, গত ১৯ ফেব্রæয়ারি দলিল লেখক মফিজুর রহমান পিয়ন মুকুটের সহয়োগিতায় সাব রেজিস্টারকে ম্যানেজ করে ৮৭১ নং একটি দলিল করেন শ্রেনী পরিবর্তন করে। তাতে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয় ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। কিন্তু বিষয়টি জানাজানি হলে পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে তড়িঘড়ি করে ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ব্যাংক চালানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, অভয়নগর থানার মনিরামপুর সড়কের শিমুলতলা এলাকার মুজিবর রহমান সরকারের ছেলে আবু মুসা সরকার ও তার স্ত্রী নাজজিনা বেগম একই থানার দক্ষিণ নোয়াপাড়ার মিজানুর রহমানের কাছ থেকে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। যার মৌজা রেট অনুযায়ী প্রকৃত মূল্য ১৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু দলিল লেখক মফিজুর রহমান বাস্তু লেখা আসল পর্চার কাগজপত্র গোপন করে সাব রেজিস্টার ইকবাল হুসাইন ও মুকুটের সাথে যোগসাজসে পর্চায় ধানী শ্রেনী দেখিয়ে জমির মূল্য দেখানো হয় ৬ লাখ টাকা। এরপর জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। এতে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে ৯০ হাজার ৫৬০ টাকা। যার দলিল নং ১১৬/২৫।
স¤প্রতি বিষয়টি ফাঁস হয়ে পড়লে দলিল লেখক ও সাব রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দেয়। সাব রেজিস্টার ইকবাল হোসাইন অভয়নগরে যোগদানের পর থেকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে শ্রেনী পরিবর্তনের মাধ্যমে জমি রেজিস্ট্রির হিড়িক পড়েছে। এর সার্বিক তত্বাবধানে রয়েছে পিয়ন মুকুট ও দলিল লেখকরা।
সূত্র জানায়, পিয়ন মুকুটের চাকরিটা সম্পন্ন অবৈধ। পিয়ন, অফিস সহকারী, মোহরার জেলার পদ। কিন্তু মুকুট পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের সাবেক আইন মন্ত্রী বি-বাড়িয়ার আনিসুল হকের নিজের জেলার বাসিন্দা। সেসময় অবৈধভাবে চাকরি নিয়ে যশোরে চলে আসেন। মুকুটের বাড়ি বি-বাড়িয়া জেলায়। শুধু তাই নয়, সরকারি চাকরিতে একই উপজেলায় তিন বছরের বেশি সময় থাকার নিয়ম না থাকলেও মুকুট এখানে ৫ বছর ধরে চাকরি করছেন।
সূত্র আরো জানায়, সাব রেজিস্ট্রার ইকবাল হুসাইনও আওয়ামী লীগের দোসর। তার চাকরিও হয়েছে অবৈধভাবে। পতিত স্বৈরাচার ফ্যাস্টিট হাসিনার পিএস সাইফুজ্জামান শিখর ও মাগুরার সাবেক প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদারের সুপারিশে তার চাকরি হয়। তার চাকরির ক্ষেত্রে কোন নিয়মনীতি মানা হয়নি।
এব্যপারে বক্তব্য জানতে সাব রেজিস্টার ইকবাল হোসাইনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফলে তার বক্তব্য নেয়া যায়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক দলিল লেখক জানান, শেরেস্তা না দিলে জমি রেজিস্ট্রি তো দূরের কথা সীমাহীন হয়রানির স্বীকার হতে হয় ভুক্তভোগীদের। তাই বাধ্য হয়েই শেরেস্তা (অতিরিক্ত ফি) দিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করতে হয়। তবে কাগজপত্রে ঝামেলা থাকলে ৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় পিয়ন মুকুটকে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রত্যেক দলিল থেকে শেরেস্তার নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হলেও সিন্ডিকেটের ভয়ে এ নিয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি হয় না।

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন