হোম অর্থ ও বাণিজ্য বিশ্বব্যাংক কি শেষ পর্যন্ত নিজেদের লক্ষ্য বদলাচ্ছে?

বাণিজ্য ডেস্ক:

ব্রেটন উডস সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের উদ্যোগে ৭৮ বছর আগে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল বিশ্বব্যাংক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি থেকে ইউরোপকে পুনরুদ্ধার করতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এ ব্যাংকের কার্যপ্রণালী ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে। বর্তমান সময়ে এসে বিশ্বব্যবস্থা যখন নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে তখন অনেকেরই প্রশ্ন, বিশ্বব্যাংকের নতুন লক্ষ্য কী হবে?

বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে দারিদ্র দূরীকরণ ও অংশীদারমূলক যথোপযুক্ত উন্নয়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক। তবে পশ্চিমা-প্রভাবিত এই ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ে মেরুকরণের এ সময়ে উঠছে নানা রকমের কথা। অনেকেই ধারণা করছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশ পশ্চিমাদের আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বলয় থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে।

নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে এবার নতুন লক্ষ্যের দিকে এগুচ্ছে বিশ্বব্যাংক। চলার পথকে নতুন আঙ্গিকে সাজানোর পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে ব্যাংকটি। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গার একটি কলাম এমনই বার্তা দিচ্ছে।

চলতি মাসে অভিমত-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে অজয় বাঙ্গা বলেছেন, বিশ্ব মোড়লরা জানেন, বিশ্বের বর্তমান সমস্যা কী কী। দরিদ্রতা নিরসনে মন্থর গতি, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে জীবনযাত্রার হুমকি, সদ্য শেষ হওয়া মহামারির ক্ষতচিহ্ন এবং ইউরোপের সীমানায় যুদ্ধের দামামা- সব মিলিয়ে বিশ্ব একটি কঠিন সময় পার করছে। আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের সঙ্গে দক্ষিণ গোলার্ধের বিশ্বাসহীনতা, অনাস্থা এবং সংঘাত ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। জলবায়ু এখন বড় একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ গোলার্ধের অনেক দেশ উত্তর গোলার্ধের মানুষের উন্নত জীবনযাপনের খেসারত দিতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্ব এখন এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যেখানে সমাধানের সঠিক পথ অস্পষ্ট হলেও, দুর্ভোগ এবং সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কিন্তু সবচেয়ে রূঢ় সত্য হচ্ছে, মুমূর্ষু পৃথিবীর না আরেকটি মহামারি সহ্য করার মতো ক্ষমতা আছে, না যুদ্ধের দামামার ভয়াবহতা বহন করার সক্ষমতা আছে।

এ অবস্থায় জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে অজয় বলেন, একেক দেশে জলবায়ুর প্রভাব একেক রকম। যখন পশ্চিমারা ভাবছেন কীভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানো যায়, একই সময় এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ব্যস্ত। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা- সব মিলিয়ে মানুষের বেঁচে থাকা থেকে শুরু করে খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া ঝুঁকির মধ্যে। যেসব শহরে কোনোদিন পানি ওঠেনি, বিগত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে সেসব শহর তলিয়ে যাচ্ছে। আবার এমন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যা বিগত সময়ের থেকে সর্বোচ্চ।

বিশ্বব্যাংক ৭৮ বছরে পা দিয়ে এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে যেখানে প্রতিষ্ঠানটির নিজেদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে আরেকবার ভাবা উচিত উল্লেখ করে অজয় বলেন, বিশ্বব্যাংক নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে চাইলে সামঞ্জস্যতা বজায় রাখতে হবে। বর্তমান বিশ্বের প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে মিল রেখে নিজেদের লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। বিশ্বব্যাংকে এমন একটি লক্ষ্য স্থির করতে হবে যেখানে বিশ্বের প্রতিটি দেশের স্বার্থ রক্ষা হয়। এমন কঠিনাবস্থায় বিশ্বব্যাংকের লক্ষ্য হওয়া উচিত: দারিদ্রমুক্ত একটি বাসযোগ্য পৃথিবী।

কিন্তু লক্ষ্য সহজে স্থির করলেও বর্তমান প্রতিকূল পরিবেশে তা অর্জন কঠিন উল্লেখ করে অজয় বলেন, সময়ের স্রোত এখন প্রতিকূলে। এই প্রতিকূলতার মধ্যেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন, কিংবা কিছু করতে হবে বলে করছি- এমন মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে লিখতে হবে নিজেদের পদযাত্রা। উন্নয়ন হবে মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, জীবনমান হবে চমৎকার আর কাজের মাধ্যমে মানুষের উন্নয়ন এমনভাবে ঘটাতে হবে যাতে দরিদ্রতাকে জয় করতে পারে সাধারণ মানুষ।

বিশ্বব্যাংকের উন্নয়নের ছোঁয়া যেন প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়, এমন আশাবাদ রেখে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেন, নারী-শিশু সবাই যেন সুবিধাভোগী হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে বিশ্বব্যাংককে কাজ করতে হবে। এমনভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে যেন সেগুলো ধকল সহ্য করার সক্ষমতা রাখে। এখানে ধকল বলতে আকস্মিক কোনো নেতিবাচক ঘটনা, কিংবা জীববৈচিত্র্য বা জলবায়ুতে বড় রকমের কোনো পরিবর্তন, মহামারী, সংঘর্ষ বা বৈশ্বিক ভঙ্গুরতাকে বোঝানো হচ্ছে। এসবের পাশাপাশি বিশ্বের খাদ্য সংকট মোকাবেলা, নতুন চাকরির বাজার সৃষ্টি, মুদ্রানীতি ও দেনা পরিশোধের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এমন সব ব্যবস্থা নিতে হবে যা খাতাকলমে না থেকে বাস্তবেও প্রয়োগ হয়।

এ বিষয়ে অজয় বলেন, ইতিহাস থেকে এখন আর শিক্ষা নেয়ার সময় নেই। প্রতিদিনই নতুন কিছু হচ্ছে, বদলে যাচ্ছে অনুমেয় সব ধ্যান-ধারণা। এ অবস্থায় প্রতিদিনকার অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক এমন কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে যেখানে কম সময়ে বেশি ফলাফল আসে। এখন শুধু অর্থ বা ব্যাংকিং ব্যবস্থা না; অর্থ কীভাবে সমাজকে বদলে দিতে পারে, কীভাবে নারীশিক্ষার উন্নয়ন ঘটানো যায় বা নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা যায় সেটা দেখতে হবে।

শুধু সরকার নয় প্রাইভেট খাতকেও উন্নত করার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রাইভেট সেক্টরগুলোর মধ্যে ডলারের লেনদেন বৃদ্ধি থেকে শুরু করে এদেরকে কীভাবে সরাসরি বিশ্বব্যাংক সহযোগিতা করতে পারে সেজন্য নতুন করে ভাবা হচ্ছে। যেহেতু বিশ্বব্যাংকের মূল উদ্দেশ্য একটি তুলনামূলক উন্নত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সেহেতু পরিধি বৃদ্ধির বিকল্প নেই।

বিশ্বকে যুদ্ধ নয়; সামগ্রিক উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে উল্লেখ করে অজয় বাঙ্গা বলেন, উন্নয়নের ধীরগতি মানে উন্নয়নের কার্যকারিতা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা। বিশ্ব মেরুকরণ, ভৌগোলিক সংঘাত বা পারস্পরিক অবিশ্বাস থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক তৈরিতে ত্রাণকর্তা হিসেবে কাজ করতে প্রস্তুত বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক একটি দর্পণ, এখানে যারা সদস্য রাষ্ট্র তাদের চিন্তাভাবনা প্রতিফলিত হয়। সেদিকে লক্ষ্য রেখে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে মহানুভবতার পরিচয় দেয়া উচিত। সবার সহযোগিতায় বিশ্বব্যাংক একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যেতে সক্ষম।

নিজেদের লক্ষ্য নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা যদি বিশ্বব্যাংককে সার্বজনীন করতে পারি তাহলে সামগ্রিক উন্নতির পথে আর কোনো বাধা থাকবে না। দারিদ্র দূর করে একটি বাসযোগ্য বিশ্ব গড়ে তোলার দৌড়ে এগিয়ে যাবো আমরা।’

সম্পর্কিত পোস্ট

মতামত দিন